পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট তথা সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চাপের মুখে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য দপ্তরের সহায়তায় পরিচালিত একটি ওয়েবসাইটে ‘বাংলাদেশ-মার্কেট ওভার ভিউ’ শিরোনামে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্বশেষ রিপোর্ট তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়-বাণিজ্য তথা পণ্য কেনার ক্ষেত্রে একটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া যদি সঙ্গত হয় তা হলে অবশ্যই মার্কিন কোম্পানীগুলো তা বিবেচনায় নেয়। দেশীয় কূটনীতিকরা এটা মানছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটি সামলে উঠতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অবশ্য এ নিয়ে এখনই হতাশ হতে চান না। তার মতে, নির্বাচনে যেটুকু ইতিবাচক দিক রয়েছে তার পেছনে নিশ্চয়ই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা রয়েছে। কিন্ত সেখানে সরকার তথা রাজনীতিবিদদের ভূমিকাও কম নয়। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি নির্বাচন সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নানা কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সুনাম কুড়িয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চা তার অন্যতম। কিন্ত সেই ‘গণতন্ত্র’ই যদি ধূসর হয়ে যায় তাহলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ভাবমূর্তিসহ সর্বক্ষেত্রেই প্রভাব পড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্য আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য নিয়ে নেতিবাচক ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল। কষ্টকর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এটি কাটিয়ে উঠেছে। আমেরিকায় বাংলাদেশের রফতানি কমে গিয়েছিল। সর্বশেষ গত বছর ৫০৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল, যা ২০১৬ সালের চেয়ে চার দশমিক ৪৬ শতাংশ কম। কিন্ত এ বছরই বাংলাদেশ দেশটিতে রফতানিতে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বছরের প্রথম ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে ছয় দশমিক ৭০ শতাংশ।
মার্কিন কংগ্রেসে রেজুলেশন পাস হওয়া ছাড়াও স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফে নিয়মিতভাবে নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হচ্ছে। এ নিয়ে ঢাকায় এবং ওয়াশিংটনে কথা বলেছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন মুখ্য উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলস। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার দলমত নির্বিশেষে সবাইকে শান্তিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রচারণার শুরুতেই সংঘটিত সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে মার্কিনিরা প্রায়শই বলছেন, সহিংসতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এতে তারাই লাভবান হয় যারা গণতন্ত্র চায় না, যারা গণতন্ত্রকে ক্ষুণœ করতে উদ্যত হয়ে আছে। মার্কিন কূটনীতিকরা দ্ব্যার্থহীনভাবে বলছেন, তারা বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থী, দল বা জোটের পক্ষে নন।
মার্কিন প্রশাসন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও জনগণের মূল্যবোধে বিশ্বাসী। তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। নির্বাচন নিয়ে কাজ করা মার্কিন সংগঠন এনডিআইকে পর্যবেক্ষণে তহবিল সহায়তা দিচ্ছেন। এনডিআই বাংলাদেশের ভোটের অবস্থা নিয়ে দুটি প্রাক-মূল্যায়ন রিপোর্ট করেছে। তারা প্রতিনিধি মারফত ভোটের দিনেও নিবিড়ভাবে কেন্দ্রগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এনডিআই’র সহযোগী ‘দ্য এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস’ও ভোট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এ ছাড়া ভোটের দিনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডের অর্থায়ন এবং প্রশিক্ষণে স্থানীয়ভাবে ১৫ হাজার পর্যবেক্ষক মোতায়েন থাকছেন।
ইউরোপের কূটনীতিকদের বিবৃতি, বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিতের তাগিদ: এদিকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর দিনে দেয়া বিবৃতিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বাংলাদেশ সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) কয়েকটি দেশ এবং নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডের মিশন প্রধানেরা। যুক্ত বিবৃতিতে তারা নাগরিকদের ভোটাধিকার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানান।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কঠোরভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এবং সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্ব পালনের আহ্বানও জানান। কূটনীতিকদের যুক্ত বিবৃতিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমালোচনামূলক রিপোর্টকে উৎসাহিত করা হয়। বলা হয়, নাগরিকদের জন্য জাতীয় উন্নয়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কার্যকর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ইউরোপীয় কূটনীতিকদের এমন অবস্থানের ব্যাখ্যায় ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে ইইউ তহবিল দিয়ে থাকে। সঙ্গত কারণেই ভোটে তাদের চোখ থাকে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুসংহতকরণে তাদের আহ্বান তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে ওই কূটনীতিক বলেন, ইইউ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। তাদের রেজুলেশনও রয়েছে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক সম্পর্কে এর প্রভাব থাকবে।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতে নতুন ঘোষিত মজুরি কাঠামোতে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে টানা আন্দোলন করেছে শ্রমিকরা। শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনড়। বন্ধ করা হয়েছে শতাধিক পোশাক কারখানা। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত শনিবার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কোর কমিটির সভায় জানানো হয়েছে যে, মজুরি নিয়ে কোন অভিযোগ থাকলে তা নির্বাচনের পর অর্থাৎ জানুয়ারিতে আলোচনা করা হবে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের বিদ্যমান মজুরি তাদের পারিবারিক চাহিদা বিবেচনায় নিলে এখনো অপ্রতুল। তবে ইতিবাচক যে, গত এক দশকে মজুরির ঊর্ধ্ব সমন্বয়ের ফলে চাহিদা ও প্রাপ্তির পার্থক্য কিছুটা কমে এসেছে। সিপিডির গবেষণায় পাওয়া গেছে, ১২ শতাংশ শ্রমিক ফ্লোরে ঘুমান, ১৭ শতাংশ শ্রমিকের ঘরে রাতে ঘুমানোর জন্য সিলিং ফ্যান নেই, ৮৩ শতাংশ শ্রমিক অন্যদের সঙ্গে টয়লেট শেয়ার করেন এবং ৮৪ শতাংশ শ্রমিক অন্যদের সঙ্গে রান্নার জায়গা শেয়ার করেন। এ থেকে বোঝা যায়, মজুরি সমন্বয়ের পরও শ্রমিকের জন্য যা দরকার, তার ন্যূনতমটুকু এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে মজুরিসংক্রান্ত আলোচনায় যেসব সূচক বিবেচনা করার কথা, তার ভিত্তিতে আলোচনা খুব সীমিতভাবেই হয়ে থাকে। প্রযোজ্য ১০টি সূচকের মধ্যে মাত্র তিনটি সূচকের তথ্য নিয়মিত প্রকাশিত হয়। বাকি সূচকগুলোর তথ্য সম্পর্কে একেক পক্ষ একেকভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে এবং এগুলোর সত্যাসত্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় আট হাজার টাকা। এর আগে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছিল সরকার। সেই হারেই এখন বেতন পাচ্ছেন শ্রমিকরা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।