Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উল্টো হাওয়া পাকুন্দিয়ায়

মাহফুজ খান | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

‘এ মন হায়, একবার দুইবার নেতা হইবার চায়’ গানের বিখ্যাত লাইনটি মূর্ত প্রতীক হয়ে ফুটে ওঠে নির্বাচনের মৌসুমে। এমন কোনো পেশা পাওয়া খুবই বিরল, যেখানে কেউ থাকে না যার নেতা হওয়ার আকাঙ্খা কম। ফলে পেশাগত সফলতা, পারিবারিক ঐতিহ্য, কিংবা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এ রকম নানা নিয়ামকের কারণেই ভোটযুদ্ধে প্রার্থীদের পরিচিতি ঘটে হেভিওয়েট বা তারকা হিসেবে। আর এ রকম দুই তারকা প্রার্থীর লড়াই হচ্ছে কিশোরগঞ্জ-২ (পাকুন্দিয়া-কটিয়াদী) আসনে।

নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন সাবেক আইজিপি, সচিব ও রাষ্ট্রদূত নূর মোহাম্মদ। আর ধানের শীষ নিয়ে মাঠে নেমেছেন আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাবেক এই দুই শীর্ষ কর্মকর্তা ভোটযুদ্ধে নামায় গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন উভয় দলের সমর্থকরা। এ পরিস্থিতিতে কান পাতলেই শোনা যায়, পাকুন্দিয়া ও কটিয়াদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, বাজার, চায়ের স্টল সর্বত্র আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় সংসদ নির্বাচন। দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর ভালো-মন্দের বিচার বিশ্লেষণ ও ভোটের হিসাব নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

মনোনয়নের পূর্বে যে কয়েকজন তারকাকে দলে টানার প্রতিযোগিতা জাতীয়ভাবে লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন নূর মোহাম্মদ। ছাত্র কিংবা পেশাগত জীবনে ভীষণভাবে সফল এই পুলিশ কর্মকর্তা নির্বাচন করছেন তা আঁচ করা যায় বছর দুয়েক আগেই। কিন্তু দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে কতটা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠতে পারেন তা আপাতত জবাবহীন প্রশ্নই থেকে গেল। আরো স্পষ্ট করে বললে কতটা আওয়ামী লীগার হিসেবে উপস্থিত হতে পারেন তৃণমূলে। বিশেষ করে, এই আসনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিনসহ ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচন করা খানিকটা বড় চ্যালেঞ্জ-ই বটে।

সমালোচকরা একধাপ এগিয়ে বলেন, গণতন্ত্রের বিজ্ঞাপন যেন তারকাতন্ত্র না হয়। কারণ, দল যখন বিপদে পড়ে তখন তারা দূরবর্তী আকাশের নক্ষত্রে পরিণত হন। দেখা যায় চেতনার করুণ কাব্য। তাই তৃণমূলে তারকার চেয়ে দলের নিবেদিত কর্মীর প্রাধান্যই বেশি। ফলে রাজনীতিবিদ না হয়েও সংসদ নামক তীর্থে পৌঁছানোর এই সাধনা যে তার জন্য মসৃণ হবে না তা হলফ করেই বলা যায়।

অপরদিকে, ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে আসা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানও জাতীয় পর্যায়ের নেতা হওয়ায় সারাদেশের স্পটলাইট তার দিকে। দল ও দলের বাইরে আলোচিত এই প্রার্থী প্রতিদিনই নজর কাড়েন টেলিভিশনের টকশো ও পত্রিকায় স্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে। তিনি নির্বাচনে এগিয়ে অনেকগুলো প্যারামিটারের ভিত্তিতে। প্রথমত, এই আসনে একাধিকবার বিজয়ী হয়েছেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশের সূত্র তার অজানা নয়। দ্বিতীয়ত, কটিয়াদীতে দুই প্রার্থী থাকলেও ধানের শীষের নির্দিষ্ট সমর্থকগোষ্ঠীর পাশাপাশি সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় রয়েছে আখতারুজ্জামানের নিজস্ব ভোটব্যাংক। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে উভয় প্রার্থী চষে বেড়াচ্ছেন এলাকার বিভিন্ন অলিগলি। দেখাচ্ছেন নানা স্বপ্নের সিঁড়ি। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রায় সব পথসভায় বলছেন, তিনি এলাকার ঋণ পরিশোধ করতে চান। তার ব্যক্তিগত জীবনের আর পাওয়ার কিছু নেই। শোনাচ্ছেন মিষ্টিমুখর নানা প্রতিশ্রুতি। রসিক এক ভোটার তো এও বললেন, নির্বাচনপূর্ব ইশতেহারে মিষ্টির তীব্রতা এতই বেশি থাকে যে, বেশিক্ষণ এর সংস্পর্শে থাকলে আপনার ডায়েবেটিস হয়ে যেতে পারে।
ইশতেহার নিয়ে এ কৌতুক নির্বাচনী সাহিত্যে বহুদিন ধরেই প্রচলিত যে, ইশতেহারের মতো একসাথে এত স্বপ্নের জোগান পৃথিবীতে আর কোথাও মিলে না। কেউ তো আবার একে তুলনা করেছেন প্রেমিকের সাথে। বিয়ের আগে প্রেমিক যে রকম সবকিছু নিমেষেই এনে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, তেমনি নির্বাচনের পূর্বে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিতেও সেরকম দৃশ্যের অবতারণা হয়। ভোটারদের সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝা গেছে, তারা বরং নির্দিষ্ট এবং সময়ভিত্তিক প্রতিশ্রুতিতেই আগ্রহ বেশি। যেমন- প্রথম বছরে কি কি কাজ করবেন বা দুই বছর কিংবা তিন বছরে কত অংশ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব ইত্যাদি

অন্যদিকে, বিএনপির প্রার্থী প্রতিশ্রুতির চেয়ে তাদের নির্বাচনে আসার মূল কারণগুলোই ব্যাখ্যা করছেন বেশি সময়। তিনি বার বার জোর দিচ্ছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ওপর। তার ভাষ্য, এবারের নির্বাচনে মূল লক্ষ্য আমার এমপি হওয়া নয়। নির্বাচনের ওপড়ই নির্ভর করছে গণতন্ত্রের আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদার মুক্তি। তার মতে এদেশে ভোটের অধিকার থাকবে কি না সেটা আপনাদের রায়েই প্রতিফলিত হবে।
তবে দুই দলের সমর্থক শিবিরে ভিন্ন আমেজ দেখা মিলে। নৌকার পক্ষে কাজ করছেন এমন অনেক কর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এবারে এই আসনে তাদের বিজয় অনেকটা সময়ের ব্যাপার। তাদের দাবি, শুধু পাকুন্দিয়া-কটিয়াদীতে নয় নূর মোহাম্মদ জাতীয়ভাবেই সফল এবং যোগ্য প্রার্থী। তার স্বচ্ছ ইমেজ ও সফল ক্যারিয়ারই বিজয়ের প্রধান নিয়ামক হবে। নূর মোহাম্মদের কলেজ বন্ধু বর্তমানে কটিয়াদী পৌরসভার মেয়র শওকত ওসমান (শুক্কর আলী) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘বিপুল ভোটের ব্যাবধানে এই আসনে নৌকা বিজয় হবে। এযাবতকালে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে এ সরকারের আমলে।’ এদিকে একই পৌরসভার বাজার পরিদর্শক আশরাফুল আলম বলেন, ‘দুই প্রার্থী হেভিওয়েট হওয়ায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনাই বেশি।

এদিকে, বিএনপি শিবিরে ভিন্ন পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলা হামলা-হামলার পাশাপাশি নতুন যোগ হয়েছে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার আতঙ্ক। তাদের আশঙ্কা সরকার যেভাবে গায়েবি মামলা আসামি করছে তাতে এটা অন্তত পরিষ্কার ব্যালট বাক্সে গায়েবি ভোটেরও সন্ধান মিলবে। তাদের যত শঙ্কা সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েই। ধানের শীষ সমর্থকদের দাবি, দশটা গোন্ডা আর পাঁচটা হোন্ডা নির্বাচন ঠান্ডা আওয়ামী লীগের পুরাতন এই সূত্রের সাথে নতুন যোগ হয়েছে গায়েবি মামলা ও ভোট। কেউ কেউ আফসোসের সুরে কবি সুকান্তকে নকল করে বলেন, গত দশ বছর আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রকে বাঁশযোগ্য করে যাব আমি’ এই অঙ্গীকারই বোধ হয় করেছে। তারা আশা করছেন, মানুষ ভোট দিতে মুখিয়ে আছে। আসছে ৩০ তারিখ ব্যালটের মাধ্যমে আওয়ামী দুঃশাসনের জবাব দেয়া হবে।

এদিকে এই আসনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে পাকুন্দিয়া উপজেলা। ৯০ পরবর্তী যতগুলো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় সবগুলো নির্বাচনে সংসদে যাওয়ার টিকিট পেয়েছিল এ উপজেলার কেউ না কেউ। এবার প্রথমবারের মতো কোনো অতিথি প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে এ উপজেলাবাসীকে। ৮ম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত (পাকুন্দিয়া-হোসেনপুর) এক আসন ছিল। ২০০৮ সালে সীমানা পুনঃনির্ধারণ হওয়ায় পাকুন্দিয়ার সাথে যোগ হয় বৃহৎ উপজেলা কটিয়াদী। ফলে নতুন সমীকরণে এই আসনে বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১৭ হাজার ২শ’ ৬৫ জন। যাতে প্রায় পুরুষ ও নারী ভোটার সমান।

পাকুন্দিয়ার ভোটের স্রোত যেদিকে থাকবে তার বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত এই বির্তকে সবাই একমত। স্বাভাবিকভাবেই এখন এই উপজেলা দুই প্রার্থীর কাছে প্রচারণার জন্য তীর্থ স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিনের বাড়ি এই উপজেলায় হওয়া ভোটযুদ্ধে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। মনোনয়নের দৌড়ে হেরে ইতোমধ্যেই যিনি নির্বাচনের ট্রেনে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। নৌকা প্রার্থী আর বর্তমান এমপির মধ্যকার শীতল সম্পর্কও রাতারাতি পরিবর্তনের কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব সমীকরণের সূত্র ধরেই এই আসনে ধানের শীষ প্রতীককে এগিয়ে রাখছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে পুরো পাকুন্দিয়ায় টক অব দা টাউনে পরিণত হয়েছে উপজেলা থেকে কোনো প্রার্থী না থাকা। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে বইতে থাকা হাওয়ায় এবারই ছেদ পড়ল। সেটিকে প্রত্যেকেই উপজেলার জন্য উল্টো হাওয়া হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ