Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গুম-অপহরণ-গুপ্তহত্যা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই

এআইজি মো. সোহেল রানা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে একের পর এক উঠিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে করে জনমনে ভীতি দেখা দিয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই এ ধরণের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির এক নেতার লাশ উদ্ধারের পর অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর সাথে গ্রেফতার আতঙ্ক তো আছেই।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন গুম ও গুপ্তহত্যার আশঙ্কায় রয়েছেন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যরাও প্রতিনিয়ত অজানা আতঙ্কে সময় পার করছেন। তবে আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কথায়, গুম, অপহারণ ও গুপ্তহত্যা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আইন-শৃংখলা বাহিনী সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। তবে কোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে দ্রুত নিকটস্থ থানায় অবহিত করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ্য থেকে।
পুলিশ সদও দফতরের এ আইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে গুম, অপহরন ও গুপ্তহত্যা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা রক্ষা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। কারো পক্ষেই আইন হাতে তুলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, কোথাও কোন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে সাথে সাথে নিকটস্থ পুলিশ ষ্টেশনে অবহিত করা হলে পুলিশ দ্রুত পৌঁছে আইনগত সহায়তা দিবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, থানা পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা পুলিশ সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করছে না। তবে কেউ যদি আইন-শৃংখলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে কোন অপরাধ করে কিংবা কাউকে তুলে নিয়ে যায় অবশ্যই এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজধানীতে এসে দলীয় মনোনয়ন নিতে যশোরের কেবশপুরের বিএনপি নেতা আবু বকর সিদ্দিক গত ১৮ নভেম্বর নিখোঁজ হন। পরদিন ১৯ নভেম্বর তার লাশ উদ্ধার করা হয় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। আবু বকর সিদ্দিক যশোর-৬ সংসদীয় আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ১৮ নভেম্বর রাতে তিনি তার ভাতিজা সুমনকে মোবাইল ফোনে জানান, তাকে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত রমনা পার্ক এলাকায় নেয়া হচ্ছে এবং টাকা না দিলে হত্যা করা হতে পারে। অপহরণকারীদের দাবি অনুযায়ী পরিবারের সদস্যরা একটি বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকাও দেন। পরে তারা আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করলে ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু দুই দফায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা বিকাশ করার পরও অপহরণকারী আবু বকরকে ছাড়েনি।
আবু বকর অপহরণ ও হত্যার পরে অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা এখন চরম আতঙ্কে ভুগছেন। অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন যাদের গ্রেফতারের পর নিয়ম অনুযায়ী আদালতে হাজির করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর সন্নিকটে আশুলিয়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে প্রায়ই উদ্ধার হচ্ছে অজ্ঞাত লাশ। এর কোনো কোনোটির পরিচয় মিলছে। আবার কোনোটি অজ্ঞাত হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে আশুলিয়া থেকে এক ব্যক্তির মস্তকবিহীন লাশের সাতটি টুকরা উদ্ধার করা হয়। পরে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি যশোরের বাঘারপাড়ার অন্তরামপুর গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকীর ছেলে। গত ৯ নভেম্বর বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। গত ২৫ অক্টোবর সকালে নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে লাশের কয়েক টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের টুকরোগুলো দেখে বুঝার উপায় নেই কিভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে পুলিশের দাবি ওই ব্যক্তি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। গত ২১ অক্টোবর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আড়াইহাজারে পাঁচরুখী ঘিদিরপাড়া এলাকা থেকে চার ব্যক্তি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা হলেন, লুৎফর রহমান মোল্লা, ফারুক, জহিরুল ইসলাম ও সবুজ সরদার। এদের মধ্যে তিনজনের মাথায় শর্টগানের গুলির চিহ্ন ছিল। একজনকে মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তাদের তুলে নেয়া হয়েছিল বলে লাশ উদ্ধারের পর থেকেই পরিবার অভিযোগ করে আসছে। লাশ পাওয়ার আগের রাতে রূপগঞ্জের ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে ফারুককে খাবার দিয়েছিলেন স্ত্রী তাসলিমা। তাসলিমা বেগমের অভিযোগ, গত ১৯ অক্টোবর তার স্বামীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছিলো। ওই চারজনের লাশ পাওয়ার আগের দিন ২০ অক্টোবর ঢাকা বাইপাস সড়কের টেংরারটেক এলাকায় লাশ পাওয়া যায় আবুল হোসেন নামে আরেক যুবকের। আবুল হোসেন এবং তার ভাই কালামকে একই দিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে।
গত ২০ অক্টোবর রাতে রাজধানীর তুরাগ থানার উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরে কাশবনের ঝোপ থেকে দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্গন্ধ পেয়ে স্থানীয়রা ঝোপের ভেতরে লাশ দু’টি দেখতে পান। প্রথমে লাশ দু’টি অজ্ঞাত ছিল। পরদিন জানা যায় তাদের নাম কামাল ও ইমন। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। পুলিশের বক্তব্য ডাকাতির মালামালের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে ডিবি।
এছাড়া গত সেপ্টেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা থেকে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেন- রাজধানীর মহাখালী এলাকার শহীদুল্লাহর ছেলে মো. সোহাগ (৩২), মুগদা এলাকার মো. আব্দুল মান্নানের ছেলে শিমুল (৩১) ও একই এলাকার আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার ছেলে নুর হোসেন বাবু (৩০)। পরিবারের অভিযোগ, যাত্রীবাহী বাস থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কে বা কারা তাদের তুলে নিয়ে যায়। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর বুড়িগঙ্গা নদী থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একই দিন কেরানীগঞ্জের তরিকুল্লাহর ডকইয়ার্ড সংলগ্ন বেড়িবাঁধ থেকে আরেক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই লাশগুলোর কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এ সময়ে যশোরের দু’টি থানা থেকে ফারুক হোসেন (৫০) ও আজিজুল হক (৪৫) নামে দুই ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার কওে পুলিশ। তাদেরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কে বা কারা নিয়ে যায়। পরে যশোরের শার্শা ও কেশবপুর থেকে দুই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা ব্যারিস্ট্যার যোবায়ের আহমেদ ভুঁইয়া হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার কাজ করছিলেন। পরে কারওয়ান বাজার থেকে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কয়েকজন আইনজীবীর পোশাক পরা অবস্থায় নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে তার কাকরাইলের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। নিচে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ডিবি পরিচয়দানকারী কয়েকজন উপরে চেম্বারে যায়। চেম্বারে থাকা বশির নামে একজনকে ধরে নিয়ে নিচে আসে। এরপর তারা দু’জনকে নিয়ে চলে যায়। যোবায়েরের বোন ডা. ফেরদৌসী জানিয়েছেন, যারা তুলে নিয়ে গেছে তাদের একজন নিজেকে ডিবির এসি শাহাদাত বলে পরিচয় দেন।
গত ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় নিউমার্কেট এলাকা থেকে কামরাঙ্গীরচর থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেনকে তুলে নেয়ার খবর পাওয়া যায়। নিউমার্কেটে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে তুলে নেয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনার একদিন পরই রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকা থেকে খন্দকার রুহুল আমিন নামে এক ব্যক্তিকে তুলে নেয়া হয় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে। রুহুল আমিন জামায়াতের হাতিরঝিল থানা পূর্ব সেক্রেটারি বলে জানা যায়।
ঘটনার সময় তিনি তার কর্মস্থলে ছিলেন। তাকে তুলে নেয়ার দৃশ্য কর্মস্থলের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সেখানে কয়েকজনের চেহারা স্পষ্ট দেখা গেছে। রুহুল আমিনের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সুরমা বলেছেন, ২৯ নভেম্বর বিকেল পৌনে ৪টার দিকে তার স্বামীকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গেছে তারা নিজেদেরকে ডিবি পুলিশের সদস্য পরিচয় দিয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ