Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি

মো. হায়দার আলী, গোদাগাড়ী (রাজশাহী) থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিবার নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’। এ ধরনের ভাওয়াইয়া গান মূলত দেশের উত্তর জনপদের প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার উপজেলার গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় গরুর গাড়ি এখন অধিকাংশ অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে। এখন ওসব রূপকথার গল্প এবং ঠাঁই নিয়েছে বইয়ের পাতায়। মাঝে মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দুই একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহর কিংবা শহরতলীতে একেবারেই দেখা যায় না।
আধুনিক সভ্যতায় ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি হারিয়ে যেতে বসেছে। শহরের ছেলে মেয়েরা দূরের কথা, গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ির সাথে পরিচিত নয়। আবার অনেক শহরে গরুর গাড়ি দেখলে শিশু তার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে এটি কি। গরুর গাড়ি হলো দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার যান বিশেষ। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুড়ে গাড়ি টানা হয়। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা।
বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পিছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজেও গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক। গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে গরুর গাড়ি এক দশক আগেও যাতায়াত ও মালামাল বহনে ব্যবহৃত হত। অনুমান করা হয়, খ্রিষ্টজন্মের ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। সেখান থেকে দক্ষিণের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসেও দক্ষিণ আফ্রিকার যাতায়াত ও মালবহনের উপায় হিসেবে গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। এইচ. রাইডার হ্যাগার্ড’ এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কিং সলোমনস মাইনস’ উপন্যাসেও গরুর গাড়ির বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাতে বিশ্রাম নেয়ার সময় বা বিপদে পড়লে তারা গরুর গাড়িগুলোকে গোল করে সাজিয়ে এক ধরনের দুর্গ গড়ে তুলে তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করত। চেঙ্গিস খানের নাতি বাতু খানের নেতৃত্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যে মোঙ্গল আক্রমণ চলে সেখানে তার প্রতিরোধে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা গরুর গাড়ির ব্যবহার করা হয়েছিল।
দুই যুগ আগে গরুর গাড়িতে চড়ে বর-বধূ যেত। গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে হতো না। বিয়ে বাড়ি বা মাল পরিবহনে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র বাহন। বর পক্ষের লোকজন বরযাত্রী ও ডুলিবিবিরা বিয়ের জন্যে ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ির ছাউনি (টাপর) সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি আসা-যাওয়া করত। রাস্তা-ঘাটে গরুর গাড়ি থেকে পটকাও ফুটাতো। গরুর গাড়িরচালক বা গাড়িওয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলত, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিবার নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’।
৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ এবং মালামাল বহনের জন্য গরুর গাড়ি বাহন হিসেবে ব্যবহার করতো। অনেক অঞ্চলে রাস্তা পাকা না থাকায় এক সময় যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করত না। ফলে গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। বর্তমানে মোটরচালিত যানের আধিক্যর কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমেছে। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের সময় গরুর গাড়ির দেখা মিলে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ