মে দিবস : আসে আর যায়
হোসেন মাহমুদবিশ্বে মানুষের যেদিন থেকে দিন যাপনের শুরু, যদিও সে ইতিহাস সুস্পষ্ট নয়, সেদিন থেকেই
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম
শ্রম দিয়ে, মেহনত করে, গতর খেটে যারা জীবিকা জোগাড় করে তাদেরকে বলা হয় শ্রমিক বা মেহনতী মানুষ। এরাই মজদুর। দুনিয়ার মজদুর এক হওÑ এই বিপ্লবী স্লোগান ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিক থেকে বিপ্লবী নীতিবাক্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ইসলাম শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা এর প্রাথমিককাল থেকেই দিয়ে আসছে। শ্রম দ্বারা যে মানুষ হালাল জীবিকা উপার্জন করে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আল্লাহ্র বন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি শ্রমিকেরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সাল্লাম নিজে কৃষিকাজ করে জমিতে ফল-ফসল উৎপাদন করে সংসার নির্বাহ করতেন, জীবিকা সংগ্রহ করতেন। তিনি এবং মানব জাতির আদি মাতা হযরত হাওয়া আলাইহিস সাল্লাম কাপড় বুনন, সেলাই, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি প্রভৃতি নিজেদের শ্রমের দ্বারাই করতেন।
কোরআন মাজিদে বেশ কয়েকজন নবীর কায়িক শ্রমের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত নূহ আলাইহিস সাল্লাম মহাপ্লাবনের পূর্বে আল্লাহর নির্দেশে এক বিশাল কিস্তি নিজ শ্রমের মাধ্যমে নির্মাণ করেছিলেন। কাঠ দিয়ে গড়া এই বিশাল কিস্তি নির্মাণে তিনি যে কাঠ ব্যবহার করেছিলেন সেই কাঠ ছিল তাঁর নিজ হাতে লাগানো গাছের। তিনতলা ও বহু কক্ষবিশিষ্ট এই কিস্তি যখন তিনি কাঠ কেটে, হাতুড়ি পিটিয়ে নির্মাণকাজে ব্যাপৃত ছিলেন তখন তা দেখে তাঁর লোকজন তাঁকে সূত্রধর বলে দারুণ ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেছিল এবং গালাগালাও করেছিল।
ইসলামে আমালুস সালেহ বা সৎকর্ম বলতে যেসব কাজের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে হালাল রুজির জন্য পরিশ্রম করাটাও রয়েছে। ইসলাম আল্লাহর দেয়া প্রগতিশীল পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে যেমন পার্থিব জীবনের সত্যিকার কল্যাণের দিক নির্দেশনা রয়েছে তেমনি আখিরাতে কল্যাণ লাভের নির্দেশনাও রয়েছে।
মানুষকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু শ্রমশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীটা হচ্ছে মানুষের জন্য আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। এখানে যে যেমন কর্ম করবে, আখিরাতে সে তেমন ফল পাবে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন, উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করার ক্ষমতা দিয়েছেন। শ্রম দ্বারা মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। মানুষ জন্মগতভাবেই শ্রমশক্তির উত্তরাধিকার লাভ করে। মূলত কায়িক শ্রম বা দৈহিক খাটুনি সাময়িক ক্লান্তিকর মনে হলেও পরিণামে তা দেহ-মনে যেমন অনন্য আনন্দ-বৈভব সৃষ্টি করে তেমনি পরনির্ভরতার লজ্জা হতে মানবিক মূল্যবোধকে উদ্ধার করার মধ্য দিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার সুপ্রশস্ত পথ করে দেয়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই শৈশবকাল থেকে সারা জীবন অত্যন্ত পরিশ্রম করেছেন। এমনকি তিনি মসজিদে নববী নির্মাণে, মসজিদে কুবা নির্মাণে, খন্দক খননে নিজে অংশগ্রহণ করেছেন।
শ্রম বিশ্ব মানবতাকে মহীয়ান করে তোলে। শ্রমের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি জগতের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব যেমন প্রমাণ করেছে তেমনি শ্রমের মাধ্যমেই তার কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু সৃষ্টি জগতের সব কিছু মানুষের অধীনে করে দিয়েছেন, যা মানুষ শ্রম প্রয়োগের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে : তিনি (আল্লাহ)-ই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত-দিন, সূর্য ও চন্দ্রকে এবং নক্ষত্ররাজিও অধীন হয়েছে তাঁরই বিধানে। অবশ্যই এতে রয়েছে জ্ঞানী কওমের জন্য নিদর্শন এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বস্তু তোমাদের জন্য (সূরা নহল : আয়াত ১২-১৩)।
ইসলাম কেবল শ্রম করার জন্য জোর তাকিদ দেয়নি শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদাও সমুন্নত করেছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অন্যের নিকট হাত পাতা অপেক্ষা দড়ি নিয়ে জঙ্গলে যাওয়া এবং সেখান হতে কাঁধে জ্বালানি কাঠ বহন করে আনা আর তা দ্বারা জীবিকা উপার্জন করা উত্তম। (বুখারি শরিফ)।
ইসলাম পৃথিবীতে প্রচলিত মনিব-চাকরের চিরাচরিত ধারণাকে নাচক করে দিয়ে সব মানুষকে মানবতার একই সততলে এনে দাঁড় করেছে। আল্লামা ইকবালের ভাষায় বলা যায়, এক সফ্মে খাড়ে হো গিয়া মাহমুদ ও আয়াজ-এক কাতারে দাঁ হয়েছে সুলতান মাহমুদ ও তার নওকর আয়াজ।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা যাদেরকে নওকর (চাকর) বল, আসলে তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। অতএব, যার ভাই তার অধীনস্থ হয় সে যেন তাকে সেটাই খেতে দেয় সে নিজে যা খায়, সে যেন তাকে সেটাই পরিধান করতে দেয়, সে নিজে যা পরিধান করে এবং সে যেন তার ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে না দেয় যা তার জন্য অসহনীয় হয়। (বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ, আবু দাউদ শরিফ)।
এই হাদিসখানি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক সহোদর ভ্রাতার মতো এবং শ্রমিকের ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া যাবে না যা করা খুবই দুঃসাধ্য। শ্রমিকের কাজের ধরন ও পরিমাণ এমন হতে হবে যেন তা তার শক্তি-সামর্থ্যরে নাগালের মধ্যে থাকে।
শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য ও সম্মানজনক মজুরি দেওয়ার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। শ্রমিকের মজুরি এমনভাবে নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে যাতে সে মালিকের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে, খেয়েপরে সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা-সমানভাবে পেতে পারে। কেউ খাবে আর কেউ খাবে নাÑ এই অসম নীতিকে ইসলাম সমর্থন করে না। শ্রমিকেরা কঠিন পরিশ্রম করে, দেহের ঘাম ঝরিয়ে উৎপাদন করবে আর সেই উৎপাদন থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে মালিক বিলাসী জীবনযাপন করবে এটা ইসলাম চায় না। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দাও। (ইবনে মাজা)।
বুখারি শরিফে সঙ্কলিত একখানি হাদিসে আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা যাদের প্রতি অতিশয় রাগান্বিত হবেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেসব ব্যক্তি যারা আল্লাহর নামে ওয়াদা করার পর সে ওয়াদা ভঙ্গ করে, যারা স্বাধীন মানুষ বিক্রি করে সেই মূল্য ভোগ করে এবং শ্রমিকের দ্বারা। পুরোপুরি কাজ করিয়ে নিয়ে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদান করে না। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেওয়াটা মারাত্মক অপরাধ।
ইসলামের আবির্ভাবের আগেই সেই আইয়ামে জাহিলিয়াতে ক্রীতদাস প্রথা সমগ্র পৃথিবীতে এমনভাবে জেঁকে বসেছিল যে, শ্রম আদায়ের নামে ক্রীতদাসের ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হতো। শ্রমজীবী মানুষকে পশুর অধম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা স্বপ্নের সুখের কথা ভাবতে পারত না। মরার পরে কবরে গিয়ে তারা সুখ-শান্তি পাওয়ার চিন্তাও করতে পারত না।
ইসলাম এই করুণ হাল থেকে মানবতাকে উদ্ধার করে অমানবিক ও অনৈতিক সব কার্যকলাপের মূল উৎপাটন করার মধ্য দিয়ে ইনসাফভিত্তিক একটি অনন্য সমতার সমাজ গড়ে তোলে। মদিনা মনওয়ারায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে সেই বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা স্থাপন করেন। ইসলামের ইনসাফভিত্তিক সমাজ সচেতনতার ছায়াতলে শ্রমিকের অবস্থান পরিবারের সদস্যের অবস্থানে পরিণত হয়।
ইসলামের চিরন্তন শান্তির আলোয় উদ্ভাসিত কাফ্রী ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রা.) মুক্ত মানুষে পরিণত হন। তাঁকে সাহাবায়ে কেরাম সম্বোধন করতেন। ‘সাইয়েদুনা’Ñ আমাদের নেতা বলে। তাঁকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় সম্মানজনক মুয়াজ্জিন পদে নিযুক্ত করেন।
ইসলামে ক্রীতদাস আজাদ করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম শত শত ক্রীতদাস আজাদ করে দেন। ইসলামই সর্বপ্রথম বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে মেহনতী মানুষ তথা শ্রমিককে সম্মানজনক মর্যাদার মসনদে অধিষ্ঠিত করেছে। একবার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মেহনতী মানুষের হাত উপরে তুলে ধরে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে বললেন, আল্লাহর কাছে এই হাত খুবই পছন্দনীয়। ইসলাম শ্রম ও শ্রমিকের যে মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে তা হৃদ্যতা, সমঝোতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে সমুন্নত। ইসলামের দেয়া শ্রমনীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে পৃথিবীতে শ্রমিক অসন্তোষ দূরীভূত করা সম্ভব।
লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।