Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিরাপদ খাদ্য কতদূর

সাকির আহমদ | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ অনেক জায়গায় বিভিন্ন নাম ও বাইরে চাকচিক্য রয়েছে এমন রেস্তোরা এবং সুপারশপে পা রেখে লোকজন প্রায় নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন। রেস্তোরায় খাবারে ভেজাল মেশানো ও সুপরাশপে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিক্রির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে রাজধানীতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১৭ কোটি টাকারও বেশি জরিমানা আদায় করেছে। তবুও থামছে না ভেজাল মেশানো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিক্রি। আর এ ব্যাপারে খাদ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে ভেজাল মেশানো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবারে মৃত্যুর শঙ্কা থাকে।
অভিজাত রেস্তোরায় পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে অথবা কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার পর খাবার খেয়ে বাজে পরিস্থিতির মুখে পড়া অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে রেস্তোরায় আগের দিনের পোড়া তেলে রান্না করে খাবার পরিবেশন করা হয়। অপরদিকে কোনো কোনো সুপারশপে বিক্রি করা হয় পচা, বাসি, পোড়া তেলে ভাজা ও ভেজাল খাবার। সুপারশপে প্রায়ই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া প্যাকেটজাত খাবার না সরিয়ে প্যাকেটের গায়ে মেয়াদ বাড়িয়ে নতুন স্টিকার লাগানো হয়। এ ধরনের কাজ ক্রেতাসহ তার পরিবারের প্রতিটি লোকের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বলছে, নামি রেস্তোরা ও সুপারশপে খাবারের নামে ভেজাল মিশিয়ে যা বিক্রি করা হচ্ছে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ফাস্টফুডের জন্য অভিজাত এলাকা হিসাবে পরিচিতি রাজধানীর বেইলি রোডে ভ্রাম্যমান আদালত এক সপ্তাহে দু’দফা অভিযান পরিচালনা করেন। গত শুক্রবার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি তাদের কাবাব তৈরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ পচা ও ছত্রাকপড়া টোস্ট বিস্কুটের গুঁড়া ব্যবহার দেখতে পান ভ্রাম্যমান আদালত। এরপর প্রতিষ্ঠানের মালিককে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদÐ প্রদান করা হয়। বেইলি রোডের পর পাশেই শান্তিনগর বাজারে ঝটিকা অভিযানে ধরা পড়ে গরুর গোশত বিক্রির ছয়টি দোকান। এসব দোকানে সিটি করপোরেশনের বেধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে গরুর গোশত বিক্রি করা হয়। একই সঙ্গে অবিক্রিত গোশত ফ্রিজে রেখেও এসব দোকানের মালিকরা বিক্রি করে আসছিল। আদালত এক লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
এর আগে গত ২৭ মে অভিযানের সময় বেইলি রোডের ফাস্টফুড দোকানের কর্মচারিরা সাজিয়ে রাখা ইফতার সামগ্রী দ্রæত সরানোর চেষ্টা করে। আদালত প্রশ্ন করতেই দোকানের লোকজন কোনো জবাব দিতে ব্যর্থ হয়। নামিদামি একটি ফাস্টফুডের দোকান মালিককে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বেইলি রোডের অনেক ফাস্টফুডের দোকানের ইফতারি মুহুর্তেই লুকিয়ে ফেলা হয়। এরপরও অপর একটি দোকানে অভিযান চালিয়ে পোড়া তেলে খাবার তৈরির প্রমান পেয়ে আদালত জরিমানা করেন।
গত ২৩ মে ধানমন্ডি এলাকায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে ইফতারির আগে র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে। আদালত ওই দোকানে ইফতার সামগ্রী তৈরিতে আগের দিনের পোড়া তেল ও অপরিশোধিত পানি ব্যবহার হাতেনাতে ধরেন। আর এ অভিযাগে এক লাখ টাকা জরিমানা করার পাশাপাশি একই এলাকায় অপর একটি রেস্তোরায় অভিযান চালানো হয়। রেস্তোরায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং খাবারের মধ্যে কাপড়ের রং মেশানোর অপরাধে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফাস্টফুডের দোকানে অপরিশোধিত পানির কারনে লোকদের মারাত্মক ধরনের রোগের আশঙ্কা ছিল। একজন ভোজনবিলাসী অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে খাবার খাচ্ছেন। খাবারের মূল্য তালিকায় একটি চিকেন ফ্রাই তৈরিতে খরচ লেখা রয়েছে ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা। কিন্তু ক্রেতাদের পকেট থেকে প্রতিটি চিকেন ফ্রাইয়ের জন্য নিচ্ছে ১৩৯ টাকা। এত টাকা নেয়ার পরও তারা পোড়া তেল দিয়ে রান্না ও অপরিশোধিত পানি গ্রাহকদের দিবে কেন? আর রেস্তোরায় জর্দা তৈরির সময় টেক্সটাইল বা কাপড়ে রং ব্যবহার করা হয়। এতে করে ক্রেতারা এই জর্দা খেলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অভিযান চললেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো সময় প্রয়োজন।
সুপারশপে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতাদের অভিযোগ, প্যাকেটজাত খাবারে একটি স্টিকারের ওপর আরেকটি স্টিকার লাগানো থাকে। খাবারের মেয়াদ শেষ হলেই ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে নতুন স্টিকার লাগানো হয়। প্রায় প্রতিটি খাবারের প্যাকেটে লাগানো থাকে ডাবল স্টিকার। মাঝে মধ্যে ক্রেতারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে কর্তৃপক্ষ নিজেদের ভুল স্বীকারসহ ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু ক্রেতাদের সবাই বিষয়টি ধরতে না পারায় ক্ষতির পাল্লা ভারি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ বা ভেজাল মেশানো খাবার অনেক সময় মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। অতি মুনাফার লোভে মেয়াদ উত্তীর্ণ ও ভেজাল মেশানো খাবার বিক্রি করা হয়। এ ধরনের খাবার খেলে ভয়ঙ্কর ডায়রিয়া হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে যায়। যারা এমন কাজ করছে তারা যতদিন সচেতন না হবে ততদিন লোকজনের ক্ষতির পাল্লা ভারি হবে। নিয়মিত মনিটরিং করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর ক্রেতাদেরও সচেতনতাই নিশ্চিত করতে পারে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, অভিযানে যেখানে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বা ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই জরিমানা করা হচ্ছে। ক্রেতারা অভিযোগ করলে তার সত্যতা পাওয়া গেলে যে অঙ্ক জরিমানা করা হয় তার অর্ধেক অভিযোগকারীকে দেয়া হয়। আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জরিমানা আদায় ও অভিযোগকারীকে সে জরিমানার ২৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হিসেবে ২০১৬ থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত অভিযোগের সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ১৪০টি। এর মধ্যে পাঁচ হাজার চারটি অভিযোগের নিষ্পত্তির মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ছয় কোটি ৮২ লাখ ১১ হাজার ৯২০ টাকা। একই সময়ে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ৮২৬টি অভিযান পরিচালনা করে। এতে এক হাজার ২৪৬টি মামলায় নয় কোটি ৭০ লাখ ৫২ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খাদ্য


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ