Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এখনও অধরা রাজশাহীর মাদক সম্রাটরা অভিযানে পাল্টেছে কৌশল

| প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


রেজাউল করিম রাজু : ক্রস ফায়ারে দু’জন মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু। একজন ইয়াবা স¤্রাটের আটক এবং পুলিশ র‌্যাবের অভিযানে বেশ কিছু মাদক ব্যবসায়ী ও সেবী আটক হলেও রাজশাহীতে তেমন প্রভাব ফেলেনি মাদক ব্যবসায়। মাদক বিরোধী অভিযানে ধরা পড়েনি নেপথ্যের নায়করা। তবে সময় বুঝে কৌশল বদলেছে। মুখচেনা ছাড়া কারো হাতে দিচ্ছেনা মাদক। ব্যবহার করা হচ্ছে নারী ও কিশোরদের। গত দু’দিন নগরীর মাদক বিক্রি বড় স্পট পদ্মা বাঁধের নীচে শেখেরচক, বাজে কাজলা, পঞ্চবটি, তালাইমারী, ডাশমারী, সবচেয়ে বড় আখড়া গুড়িপাড়া, টুলটুলিপাড়া, শিরইল কলোনী এলাকা পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় সবাই বেশ সতর্ক। অপরিচিত লোক দেখলেই তার গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে। বাধের উপর রয়েছে লোকজন। পুলিশ র‌্যাবের গাড়ির উপর নজর রাখা হচ্ছে। অভিযানে আসলে সটকে পড়বে চলে আসবে বাধের এপারের এলাকায় কিংবা আশেপাশে। এখানে ইয়াবা বাবা নামে ফেন্সিডিল ডাইল আর হেরোইন ধোঁয়া নামে পরিচিত। এসব কোর্ড নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশ ক’জন বিক্রেতা জানালো এখন কড়াকড়ি চলছে। তাছাড়া রমজান মাসে দিনের বেলা চাহিদা কম থাকে। তাছাড়া এসবের বড় ক্রেতা এখানে লেখাপড়া করতে আসা শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী শিক্ষা নগরী হওয়ায় এখানে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে তারা সফলও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় রমজানের ছুটি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরেছে। ফলে কমেছে নদীর তীরের ভীড়। এদের কাছে ফেরী করে বিক্রি করা হতো। এদের বাইরে রয়েছে নিয়মিত অনেক মাদক সেবী। শিরোইল কলোনী হাজরা পুকুর এলাকায় এক বাগানে তিন চারজন মাদক সেবীকে শুয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। এলাকাবাসী জানালো ওরা রোজ সকালে আসে আর বিকেলে যায়। নেশা করে। টিনের মসজিদের পাশেই আক্কাস নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর আখড়া সেখান থেকে মাদক বিক্রি হয়। এনিয়ে লোকজনের ক্ষোভ কম নয়। তারা অভিযোগ করে বলেন এখানে সাদা পোশাকে নিয়মিত পুলিশ আসে। বখরা নিয়ে যায়। তাই আক্কাসের এতো জোর। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনা। তাছাড়া প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো মাদক ব্যবসায়ী বলে ফাঁসিয়ে দেবার উদাহরন রয়েছে। ভারতের সীমান্ত লাগোয়া জেলা রাজশাহী হওয়ায় পদ্মা নদী পেরিয়ে খুব সহজে আসছে ইয়াবা হোরোইন গাজার আর ফেন্সিডিল। এসব খুচরো পাইকারী দু’ভাবেই বিক্রি হচ্ছে। নগরী ও উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত মাদকের নেটওয়ার্ক। চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পবা মেট্রোপলিটন পুলিশের থানা সমূহ বিশেষ করে কাশিয়াডাঙ্গা রাজপাড়া বোয়ালিয়া মতিহার চন্দ্রিমা থানা এলাকা চারঘাট বাঘা জুড়েই মাদকের রমরমা ব্যবসা। নগীর গুড়িপাড়া মাদকের ড্যান্ডি নামে খ্যাত। অন্যদিকে গোদাগাড়ী থানা মাদক স¤্রাটদের স্বর্গরাজ্য। চারঘাট বাঘার সীমান্ত এলাকাতে মাদকের ব্যবসা জমজমাট। ভারত থেকে খুব সহজে সীমান্ত গলিয়ে চলে আসছে মাদকের চালান। বাংলাদেশের জন্য ভারতের মালদা মুর্শিদাবাদ সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে অনেক ফেন্সিডিল তৈরী কারখানা। নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ রয়েছে ফেনসিডিল, হেরোইন,গাজা মদের। ইয়াবার বড় চালান আসে মিয়ানমার থেকে। শিবগঞ্জ সীমান্ত মাদকের সাথে আসে অস্ত্র। বিষয়গুলো এখন ওপেন সিক্রেট। যেন গা সওয়া ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সহজলভ্য হওয়ায় মাদকের ক্রেতা বেড়ে চলেছে মারাত্বক রকমের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্র ছাত্রী কর্মকর্তা কর্মচারী চিকিৎসক প্রকৌশলী ব্যবসায়ী বিভিন্ন পেশার মানুষ ইয়াবা ফেন্সিডিল হেরোইন গাজায় আসক্ত। বহু পরিবারের একাধিক সদস্য আসক্ত হয়ে পরিবারের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। ভেঙ্গেছে সাজানো সংসার। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি তত ভয়াবহ হচ্ছে। সীমান্ত থেকে শুরু করে নগর শহরের আনাচে কানাচে পর্যন্ত বিক্রির স্থানগুলো চলছে সব ম্যানেজ করে। অভিযোগের তীর রয়েছে এসব দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে। তাদের ম্যানেজ ছাড়া এমন খোলা মেলা ব্যবসা অসম্ভব। সীমান্তে বিজিবি আর এপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি চক্র জড়িয়ে রয়েছে। যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে অভিযান চালায়। সর্ষেয় ভূত থাকা আর ক্ষমতাসীনদের আর্শিবাদে সব সময় অধরা থাকছে মূল ব্যবসায়ীরা। এখানকার অনেক এমপি জনপ্রতিনিধির নাম এসেছে মাদক ব্যবসার পৃষ্টপোষক হিসাবে। এনিয়ে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি কম নয়। প্রচারনা রয়েছে মাদকের টাকা ভোটের রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যায়। তাছাড়া রাতারাতি বিত্তবান হবার সহজ উপায় হলো মাদক ব্যবসা। একেবারে ফুটপাত থেকে আসা লোকজন মাদক ব্যবসা করে রাতারাতি জিরো থেকে কোটিপতি বনে যাবার উদহারন অনেক । মাদকের স্বর্গরাজ্য গোদাগাড়ির এমন নজির রয়েছে অনেক। যারা এখন চড়েন দামী গাড়িতে নগরীতে বিশাল বিশাল মার্কেটে দোকান বাড়ি করেছেন। ফ্লাট কিনেছেন। আম বাগান জমি সবকিছু হয়েছে কিন্তু ব্যবসা ছাড়েননি। নগরীতে এমন অনেক নাজির রয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টে নাম এসেছে। কিন্তু তারা রয়েছে বহাল তবিয়তে। দেশজুড়ে অভিযান শুরু হওয়ায় এদের অনেকে চলে গেছে ভারতে। সেখানে রয়েছে তাদের সরবরাহকারীরা। বেশ জামাই আদরে রয়েছে তারা। কেউ গেছে চিকিৎসার নাম করে। ওপারে থেকে খোজ খবর রাখছে। নির্দেশনা দিচ্ছে।
বর্তমান ও আগের দু’জন পুলিশ কমিশনার নগরীতে মাদকের ভয়াবহতা দেখে বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও যুব সমাজের দিকে খেয়াল রেখে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে মাঠে নামেন। নগরীর মাদকের আখড়ায় গিয়ে সভা সমাবশে করে এসব বিক্রির বন্ধের আহবান জানান। মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিলে তাদের পুন:বাসনের জন্য রিক্সা ভ্যান, সেলাই মেশিনসহ বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেন। অভিযান চালিয়ে বহু মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীকে ধরেন জেলে পাঠিয়েছেন। আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে আবার তারা ফিরে গেছে পুরানো ব্যবসায়। সম্প্রতি বেশকিছু অভিযান চালিয়ে পুলিশ র‌্যাব অনেক মাদক সেবীকে ধরেন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবীদের কারাদন্ড দিয়েছে। বেশ কটা মাদকের বড় চালান আটক করেছে। তারপরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। গত বছরের শেষ দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সুরক্ষা সেবী বিভাগ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে দেশের সরকারী বেসরকারী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী শিক্ষক কর্মচারী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সমন্বয়ে মাদক তথা ইয়াবা চক্র গড়ে ওঠার উপর বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েটে) পুরকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপকসহ বিভিন্ন পয্যায়ের আটজন কর্মকর্তা কর্মচারী ও আরো দু’জন ছাত্রীর নাম রয়েছে। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশী বলে ক্যাম্পাস সূত্রে জানাগেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, রেজিষ্ট্রারসহ বিভিন্ন পয্যায়ের চৌদ্দজন কর্মকর্তা কর্মচারীর নাম উঠে এসেছে। রয়েছে কুড়িজন শিক্ষার্থীর। অথচ প্রতিবেদনটি সরকারীভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠালেও তারা এদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ভূমিকা নেবার খবর পাওয়া যায়নি। অথচ সুপারিশে বলা হয়েছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমূহে অবৈধ মাদকের বিশেষ করে ইয়াবার ব্যবহার চলতে থাকলে জাতি ক্রমান্বয়ে মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে অশ্লিলতা ও পাশবিকতা বেড়ে যাবে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা মারাত্বক হুমকীর মুখে পড়বে।
জানাগেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হলের পেছনের মাঠ, চারুকলা মাঠ, মাদারবক্স ও সোহরাওয়ার্দি হলের পুকুর পাড়, জিমনেসিয়ামের পাশের খেলারমাঠ, পশ্চিমপাড়া, টুকিটাকি চত্ত¡র মাদকের স্পট। এর বাইরে রেলস্টেশন, বিনোদপুর বাজার, কাজলা কেডি ক্লাব মাদকের স্পট। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন আমরা মাঝে মধ্যেই অভিযান চালাচ্ছি। তাদের ধরছি। ভয়াবহতা সম্পর্কে বোঝাচ্ছি। অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করছে ছাত্রলীগের একটা অংশ। রাজশাহী মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সতর্ক রয়েছি। প্রতিদিন অভিযানে মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারী আটক হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকা হবার কারনে মাদক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনে আনা যাচ্ছেনা। জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য হলো পদ্মা পাড়ের গোদাগাড়ী চারঘাট ও বাঘায় সবচেয়ে মাদকের সংখ্যা বেশী। এসব থানাকে মাদক নিয়ন্ত্রনের বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ