Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

কুমিল্লায় পাড়ায় পাড়ায় বাড়ছে কিশোর সন্ত্রাসী

কুমিল্লায় আতঙ্কের প্রধান কারণ সেভেন স্টার গ্রæপ

| প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

 মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা থেকে : চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ এখন পেছনে ফেলে কুমিল্লায় কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের সন্তানরা পা বাড়াচ্ছে এ অন্ধকার জগতে। তাদের অনেকে মাদকাসক্তও হয়ে পড়ছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে ছিনতাইয়ের মতো অপারাধেও জড়াচ্ছে তারা। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে পড়ছে নৃশংস খুনাখুনিতে। কুমিল্লায় এখন আতঙ্কের প্রধান কারণ সেভেন স্টার গ্রæপ। ফেসবুকে “সেভেন স্টার গ্রæপ’’ নামে আইডি খুলে ছবি পোস্ট করে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানো হয় ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ, টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে চাঁদা আদায় অভিযোগ রয়েছে গ্রæপটির বিরুদ্ধে। মা-বাবার উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে অনেক কিশোর নির্বিঘেœ বিপথে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সামাজিক মূল্যবোধহীন এক সমাজে বেড়ে ওঠা এসব কিশোর ক্রমেই যেমন অস্থির হয়ে উঠছে, তেমনি পরিবারের অজান্তেই হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। গড়ে তুলছে নিজস্ব গ্রæপ। অধিপত্য বিস্তারে এক গ্রæপ আরেক গ্রæপের ওপর হামলা চালাচ্ছে। গত ১০ মে কুমিল্লার বাগিচাগাঁত্ত বড় মসজিদ এলাকায় রাত ১১ টায় অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দু’গ্রæপে কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক সংর্ঘষ হয়। এসময় দু’ গ্রæপের কিশোরদের হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র-সস্ত্র দেখা যায়। এসময় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। গত ৪ এপ্রিল প্রেম সক্রান্ত ঘটনায় কুমিল্লা সরকারী কলেজের একছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কুমিল্লার রেইসকোর্স এলাকায় কলেজ ছাত্র সাগর দত্তকে (১৯) হত্যা এবং তার বন্ধু সজিব সাহাকে (১৮) গুলি করে হত্যার চেষ্টার পেছনে প্রেম সংক্রান্ত দ্বন্ধ রয়েছে বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার রেইসকোর্স এলাকায় তিনতলা ভবনের নিচ তলায় ৬ জন তরুণ যুবক থাকতেন। ঘটনার দিন ভোর সাড়ে ৬ টায় হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে গেলে দুই জনকে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে দেখতে পায়। রুমের ভিতরে গিয়ে দেখেন দুইজনের মুখে স্কচটেপ লাগানো। একজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নড়াচড়া করছে। তাদের মধ্যে প্রেম সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দ্ব›দ্ব চলছিল। সেই জেরেই এই হত্যাকান্ডটি ঘটেছে। নিহত সাগরের গলায় ছুরিঘাকাত করে হত্যা করা হয়। আর আহত সজিব সাহার বুকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, একটি ছুরি ও বটি উদ্ধার করা হয়েছিল। কুমিল্লায় এর আগেও এ রকম বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই কিশোর খুনি বা অপরাধীদের মধ্যে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বস্তির বাসিন্দা কিশোররাও। কিশোর অপরাধ নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। কিশোর অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিশোরদের এভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার কারণ কী? এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মোঃ জাকির ছায়াদউল্লাহ খান দৈনিক ইনকিলাকে বলেন, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার অভাবই এর জন্য দায়ী। সন্তানের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের প্রতি অভিভাবকদের যতটা মনোযোগ দেওয়া দরকার, প্রায় তা দেওয়া হয় না। সন্তান যা চায়, তাই দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে চায়। চালকের লাইসেন্স না থাকলেও তার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেওয়া হয়। মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া হয়। এরা রাস্তায় রীতিমতো ত্রাসের সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনাও ঘটায়। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কিন্তু সেই অভিভাবকরা সন্তানের কোনো অপরাধই দেখতে পান না। মাদকবিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের জন্য কিশোরদের অপরাধ জগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকান্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন। ফলে একসময় এই কিশোররা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরা হয়ে ওঠে নেশাগ্রন্ত ও সম্পূর্ণরূপে একেকজন অপরাধী।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমান সময়ে কুমিল্লায় কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, যা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে দল বেঁধে আড্ডা দেয়, মেয়েদের ইভটিজিং করছে। বড়দের সামনে প্রকাশ্যেই একের পর এক সিগারেট ফোঁকে। বখে যাওয়া এসব সস্তান কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তার বেশিরভাগ খবরই রাখেন না তাদের অভিভাবকরা। কিশোর বয়সে দামি ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং নতুন নতুন বন্ধু তৈরির সঙ্গে ধীরে ধীরে অসৎ সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। কুমিল্লায় নতুন করে সেভেন স্টার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সবার মাঝে। স¤প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের প্রধান কারণ সেভেন স্টার গ্রæপ। প্রথমত, গ্রæপটি বিভিন্ন দেয়ালে চিকা মেরে ও ফেসবুকে গ্রæপের নাম ও ছবি পোস্ট করে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানো হয়। পরে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, পথচারীর কাছ থেকে টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে চাঁদা আদায় এবং চাঁদা না পেলে মারধর করে আহত করাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে গ্রæপটির বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ এক মুক্তিযোদ্ধার নবম শ্রেণিতে পড়–য়া ছেলেকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে গ্রæপটির সদস্যরা। এ ঘটনায় তার পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে গ্রæপটির সদস্যরা। সেভেন স্টার গ্রæপটির অধিকাংশ সদস্য উপজেলা সদরের প্রভাবশালী পরিবারের সস্তান হওয়ায় আশপাশের ২০ গ্রামের বাসিন্দারা আতঙ্কিত। গ্রæপটির প্রধান শাওন (২১) রহিমপুর গ্রামের জসিমের ছেলে। অপর সদস্য রাব্বি (২০) উপজেলা সদরের তকদিরের ছেলে। মফিজের ছেলে শাহজালালসহ (২৩) বেশ কয়েকজন এই গ্রæপের সক্রিয় সদস্য বলে, বিভিন্ন অভিযোগ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। থানায় অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বলেন, আমার ছেলে মুরাদনগর ডিআর সরকারি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। রহিমপুর গ্রামের কয়েকজন ছেলের সঙ্গে তাদের (সেভেন স্টার গ্রæপ) মেয়ে সংক্রান্ত বিরোধ ছিল। আমার ছেলের বাড়ি রহিমপুর মনে করে তাকে মারাত্মভাবে পিটিয়ে আহত করে তারা। তিন দিন সে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলে উল্টো গ্রæপটির সদস্যরা আমাকে ও আমার পরিবারের লোকজনকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে বলেন, ধামঘর ইউপির ভুবনঘর গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্রী আকলিমা (ছদ্ম নাম) এই সেভেন স্টার গ্রæপের উত্ত্যক্ত কারণে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাখরাবাদ গ্রামের জামালের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও তার পকেট থেকে ৩০০ টাকা এবং মুরাদনগরের বাবুর কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও দুই হাজার ৫০০ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া মধ্যনগর গ্রামের এক হিন্দু পরিবার থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে তারা। গ্রæপটি করিমপুর গ্রামের ব্যবসায়ী মতিনের ছেলের কাছ থেকে ৪৮ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় বলে তার পরিবার সূত্র জানায়। এই গ্রæপের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, যদি কেউ জমি কেনাবেচা করে অথবা জমিতে মাটি ভরাট বা বাড়িতে বিল্ডিং তৈরি করে তাহলে তার চাঁদা দাবি করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, উঠতি বয়সী বখে যাওয়া ছেলেরা প্রভাবশালী পরিবারের সস্তান হওয়ায় ভয়ে অনেকেই মুখ খোলার সাহস পায় না। তবে দিন দিন তারা বেপরোয়া হয়ে এলাকাবাসীর আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেভেন স্টার গ্রæপটির প্রধান, শাওনের এক আত্মীয় বলেন, পরিবারের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে সে। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে কয়েকদিন তার কোনো হদিস থাকে না। গ্রæপের অপর সদস্য রাব্বি নেশায় আশক্ত হয়ে নানান অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে পরিবার তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু রাব্বি দুই মাসের মাথায় বিদেশ থেকে ফিরে এসে সেভেন স্টার গ্রæপের সক্রিয় সদস্য হয়ে যায়। এ বিষয়ে মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মনজুরুল ইসলাম বলেন, সেভেন স্টার গ্রæপ সর্ম্পকে অভিযোগ পেয়েছি এবং অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এই গ্রæপটির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া আশ্বাসও দেন এই কর্মকর্তা।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ