Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সড়কে চলছে বিরতিহীন হত্যাকান্ড

| প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


সাখাওয়াত হোসেন : কোনো ভাবেই থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা। দীর্ঘ সড়ক দুর্ঘটনার তালিকায় বাদ যাচ্ছে না রাজধানীরও। রক্তের দাগ শুকানোর আগেই আবারো রক্ত ঝরছে। লাল হচ্ছে কালো পিচ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি টাকার গাড়ি। পঙ্গু হচ্ছে শতশত সাধারণ মানুষ। মাদকাসক্ত ও অদক্ষ চালকদের অনিয়ন্ত্রিত ভাবে গাড়ি চালানো, অপরিকল্পিত সড়কের কাঠামো ও মহা সড়কের উপর হাট বসানো এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।
এনিয়ে প্রতিনিয়তই কথা বলা বা লেখালেখির পরেও কাজের কাজ একেবারেই হচ্ছে না। চিহ্নিত ডেথ স্পর্টগুলোতে সাইনবোর্ড ঝুলানো ছাড়া কোনো কাজ চোখে পড়েনি। যাত্রাবাড়ী থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন নাজিম উদ্দিন। ৩২ বছরের তরতাজা প্রাণ। নাজিম ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ছিলেন। গন্তব্য গুলিস্তান। মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে উঠতেই তিনি পড়ে গেলেন দুই বাসের প্রতিযোগিতার মুখে। মঞ্জিল ও শ্রাবণ সুপার পরিবহনের দুটি বাস মরিয়া কে কার আগে যাবে। শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাসটি নাজিমের মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। ছিটকে সেতুর সড়কে পড়ে গেলেন তিনি। নিমেষে বাসটি চলে গেল তার বুকের ওপর দিয়ে। মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে গতকাল এভাবেই প্রান গেল নাজিম উদ্দিনের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল মাহমুদ ও নাইম ইসলাম নামের দুই যুবক। তারাও মোটরসাইকেলে করে গুলিস্তানের দিকে আসছিলেন। তাদের ভাষ্য, আহত নাজিমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান রাসেল। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
ঢাকা ট্রিবিউনের সাংবাদিক রাব্বী রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, যাত্রাবাড়ীর শ্যামপুর এলাকায় নাজিমের বাসা। তিনি তিন দিন আগেই সন্তানের বাবা হয়েছেন। তার স্ত্রী এখনো অসুস্থ।
প্রত্যক্ষদর্শী নাইম আরো জানান, নাজিমকে শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাসটি চাপা দেয়ার পর তিনি (নাইম) মোটরসাইকেল চালিয়ে গুলিস্তানের সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সে যান। সেখানে দায়িত্বে থাকা এসআই মো. সোলায়মানকে ঘটনা জানান। এরপরই শ্রাবণ সুপার পরিবহনের চালক ওহিদুলকে আটক করেন এসআই সোলায়মান। পরে অপর বাস মঞ্জিল পরিবহনের চালকের সহকারী কামালকে আটক করা হয়।
পুলিশ জানায়, আটক ওহিদুল ও কামালকে যাত্রাবাড়ী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া বাস দুটিও আটক করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, তাদের মোটরসাইকেলটি প্রতিযোগী বাস দুটির পেছনে ছিল। আর নাজিমের মোটরসাইকেলটি ছিল বাস দুটির সামনে। দুটি বাসই বেপরোয়াভাবে চলছিল। এর মধ্যে শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাসটি নাজিমের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। নাজিম ছিটকে পড়লে তাঁর বুকের ওপর দিয়েই বাসটি চলে যায়। ঘটনার পর তিনি মোটরসাইকেল থেকে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নাজিমকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। পথে তার প্রাণ ছিল। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে আনার পর তিনি মারা যান। নাজিমকে চাপা দিয়ে চলে যাওয়া শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাসের চালক ওহিদুল আটক হওয়ার পরও স্বাভাবিক ছিলেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আটক ওহিদুল ও কামালকে থানায় রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিক যাত্রী ও মুনাফার লোভে কে কার আগে যাবে এ নিয়ে চালকদের এই দৌরাত্ম্য বছরের পর বছর চলে আসছে। তাদের অভিযোগ, চালকদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামানোর কেউ নেই। আর কারণেই রাজপথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলও বড় হচ্ছে। গতকাল সকালে মতিঝিল শাপলা চত্বরে সোনালী ব্যাংকের সামনে, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরগামী এটিসিএল, এফটিসিএল ও বাহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির বড় বাসগুলো একটার পেছনে আরেকটা লেগে আছে। সামনের বাস না সরলে পেছনের বাসটা সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে। একই অবস্থা গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ সড়কে। শিকড়, শিখর, বোরাক, আনন্দ কোম্পানির বাসগুলো চলাচল করে কোনও শৃঙ্খলা না মেনেই।
দেখা গেছে, ট্রাফিক পুলিশের সামনেই প্রতিটি স্ট্যান্ডে বাস চালকরা বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি রাখেন, যাত্রী তোলেন। সিটগুলো যাত্রীতে পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ স্ট্যান্ড ছাড়তে চান না। যাত্রীদের চাপাচাপিতে বাসটি যখন অপর স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যায়, তখন এর গতি থাকে বেপরোয়া। এ ক্ষেত্রেও কে কার আগে যাবে, তা নিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তখন সড়ক দিয়ে পারাপার হতে থাকা পথচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। ফলে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে নিরীহ পথচারীরা।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য মতে, সারাদেশে এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার মাসেই এক হাজার ৭৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৮৪১ জনের মৃত্যু ও পাঁচ হাজার ৪৭৭ জন আহত হয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ২৮৮ জন। আগের বছর ২০১৭ সালে চার হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাত হাজার ৩৯৭ জন। ২০১৬ সালে চার হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছিলেন। বিগত বছরের তুলনায় ২০১৭ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। নিহত ২২ দশমিক ২ শতাংশ এবং আহত ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েকমাসে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। হাইওয়ে ও শহরের মধ্যে দুর্ঘটনার ধরণ ও কারণ ভিন্ন। শহরের দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রথমেই বলতে হবে গণপরিবহনের কর্মীদের দায়িত্বহীনতার কথা। গণপরিবহনের যে মান থাকার কথা তা নেই। অথচ আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ নেই, মুনাফা বাড়ানোর জন্য চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালায়, ১৬ ঘণ্টা টানা বাস চালাচ্ছে, বেতন কাঠামোর ঠিক নেই। এরকম একটি বড় সিটিতে এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা চালানো হলে দুর্ঘটনা ঠেকানো যাবে না।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজহধানীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। দৈনিক চুক্তিভিক্তিক ইজারায় মালিকরা তাদের বাস চালকের হাতে তুলে দেন। এ কারণেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য সড়কে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। গণপরিবহন পরিচালনায় এ ধরনের ব্যবস্থা আর কোনও দেশে নেই। এই অরাজকতা বন্ধ করা না গেলে নগরে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়রম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও যখন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় না, তখন মানুষ শৃঙ্খলা হারায়। প্রতিটি দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় যদি যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো তাহলে কিছুটা সতর্কতা অবশ্যই আসতো। সেটি না হওয়াতেই আমাদের সড়কে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় রোজ মানবাধিকার পিষ্ট হচ্ছে। প্রান হারাচ্ছে মানুষ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ