Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যে কারণে নিয়ন্ত্রণহীন ডলারের দাম

| প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ডলারের দাম। চলতি অর্থবছরের জুলাই শেষে আন্তঃব্যাংক ডলারের দর ছিল ৮০ দশমিক ৬৬ টাকা।
গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকে নগদ ডলার সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে দুই টাকা। আর এক বছরে চার টাকা বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবাহ কম হওয়ায় এবং বৈশ্বিকভাবে চাহিদা বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে পারে। যে হারে খরচ হচ্ছে, আয় আসছে না সে হারে। তারা আরো বলছেন, নগদ অর্থকে নিরাপদে রাখতে হয়তো কেউ কেউ নগদ টাকায় ডলার কিনে তা পাচার কিংবা নিজেদের কাছে জমা করছে। ফলে হু হু করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের চাহিদার কারণেই দাম বাড়ছে। প্রচুর এলসির দেনা শোধ করতে হচ্ছে। তবে রফতানি ও রেমিটেন্স খাত থেকে সে পরিমাণ আয় আসছে না। এ কারণেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এদিকে চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার বেড়ে যায় ব্যাপকহারে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যায়। অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী বছরের রিজার্ভের স্থিতি বিশ্লেষণ করে এমনটাই দেখা গেছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। ওই ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০১৩ সালে নির্বাচনের বছরটিতে। সে বছর এক হাজার চার কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচার হয়। এর আগে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন বছর ২০০৮ সালে। ওই বছর পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৭২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
সূত্র জানায়, কয়েকটি উপায়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার হয়। এর মধ্যে আমদানি-রফতানি, ক্যাশ ও হুন্ডিতেই সবচেয়ে বেশি। যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সরকারি প্রণোদনা পেতে রফতানি পণ্যেও বেশি মূল্য দেখানো হয়। অথচ সেই আয় দেশে আসছে না। অন্যদিকে ভুয়া রফতানি আয় দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পণ্য ও সেবা খাতে প্রচুর পরিমাণ আমদানি ঋণের দায় পরিশোধ হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে এক ধরনের টান সৃষ্টি হয়েছে ডলারের বাজারে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য আমদানিতে পাঁচ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল তিন হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে দুই হাজার ২৮ কোটি ডলার বা এক লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগই আমদানি হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী যন্ত্রপাতি। অথচ এ খাতে আমদানি বাড়লেও শিল্প স্থাপন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে না।
এ ছাড়া এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল এবার ১৪০ কোটি ডলারে উঠেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মেয়াদে আকুর বিল ১৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে উঠেছিল। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপÑএই নয় দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার আকুর বিল পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে শোধ করা হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে আকুর বিল ছিল ১৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ইনিস্টিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার, যার ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং; আমদানি-রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা, একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সাধারণত যে জিনিসের চাহিদা বেশি হয়, তার দাম বাড়ে। এখন বুঝা যাচ্ছে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। ফলে দামও বাড়ছে। কিন্ত কেন চাহিদা বাড়ছে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেখতে হবে, আমদানি বাড়ছে কি না। তবে আমার ধারণা, যে হারে ডলারের দাম বাড়ছে, সেই হারে আমদানি বাড়েছে না। তিনি বলেন, রফতানি বাড়লেও ডলারের দাম বাড়ে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে এখন রফতানি বাড়ছে-এমন চিত্রও চোখে পড়ে না। এছাড়া রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেলেও ডলারের দাম বাড়ে। তবে রেমিটেন্স তো তেমন কমেনি বরং এখন বাড়ছে। তাই এসব বিষয়ে বিবেচনা করলে সন্দেহ তৈরি হয় যে, হয়তো কেউ কেউ নগদ টাকায় ডলার কিনে তা পাচার করছে অথবা জমা করছে। কারণ বিভিন্ন দিক চিন্তা করে অনেকে ডলার জমা করেও রাখতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
দুটো কারণে ডলারের দাম বাড়তে পারে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিকভাবে ডলারের চাহিদা ও দেশে আমদানি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডলারের চাহিদা বাড়ছে, তাই বিশ্বের অন্যন্য দেশ থেকে সেখানে ডলার যাচ্ছে। ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত, ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকায়ও ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমছে। এ কারণে ডলারের ডাম বাড়তে পারে। তিনি বলেন, এছাড়া দেশে আমদানি বেড়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা বেড়েছে। এছাড়া ডলারের বাজারে কারও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমত দাম বাড়াচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীদেরও খরচ বেড়েছে। টাকা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানিকারকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান বলেন, আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। এতে ডলারের উপর চাপ বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো প্রযোজনের তুলনায় বেশি ডলার ধরে রাখছে। এসব কারণে ডলারের দাম বেড়েছে। তবে বর্তমানে ডলারের দাম একটু বেশিই বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে আমাদের এটি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব আছে। এ বিষয়ে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

Show all comments
  • সাইদুর ১০ মে, ২০১৮, ৩:২৩ এএম says : 0
    এই বিষয়ে সরকারের বিশেষভাবে নজর দেয়া উচিত
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডলার

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৬ জানুয়ারি, ২০২৩
৫ ডিসেম্বর, ২০২২
১৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ