Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এডিপি বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত গতি নেই

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

চলতি অর্থবছর শেষ পর্যায়ে। কয়েকদিন পরেই নতুন অর্থবছরের বাজেট। অথচ এখনও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত গতি নেই। জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের সব মন্ত্রনালয় ও বিভাগ মিলে ৮২ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কাটছাট করে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (আরএডিপি) আকার ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রথম ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৪২ শতাংশে। পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যালোচনায় এ সব বিষয় উঠে এসেছে। যদিও পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চলতি অর্থবছরে শতভাগ অর্থ ব্যয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে মনিটরিংয়ের কারণে আগের তুলনায় এখন এডিপি বাস্তবায়নের হার ভালো। এছাড়া প্রকল্পের কাজে গতি আনতে সচিব ও প্রকল্প পরিচালকদের সাথে বৈঠকসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
অবশ্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন না হওয়া বাংলাদেশের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি বছর সরকার যে এডিপি গ্রহণ করে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না। এডিপি বাস্তবায়নে কোনো কোনো প্রকল্প ধীরগতিতে এগোলেও অনেক প্রকল্পের কাজ শুরুই হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন করুণ চিত্রের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারের প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থাগুলোর দুর্নীতি ও অনিয়মকে দায়ী করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাই এসব দপ্তর বা সংস্থার দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধ করে সুশাসন নিশ্চিত করার পক্ষে বলে মত দিয়েছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরুতে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকার এডিপি প্রনয়ন করা হয়েছিল। বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে ৬ হাজার ৪৯১ টাকা কেটে নিয়ে আরএডিপি নির্ধারণ করা হয়। ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকায়। এবার আরএডিপির শতভাগ অর্থ ব্যয় করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে আসছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ লক্ষ্য প‚রণ করতে হলে দুই মাসে ৭৪ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
সূত্র জানায়, এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনতে অর্থবছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়। ৩৫০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রয়েছে এমন ৮৬ প্রকল্পে গতি আনতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। পরবর্তীতে বেশি বরাদ্দ পেয়েও বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে রেলপথ মন্ত্রনালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে তিনি ডেকে পাঠান। আলাদা বৈঠক করেন সড়ক পথ ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও। বিদেশি সহায়তা পাওয়া প্রকল্পে গতি আনতে দাতাদের পাশাপাশি বাস্তবায়ণকারী সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে অর্থ মন্ত্রনালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
এ বিষয়ে আইএমইডির সচির মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বড় বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রনালয় ও বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আইএমইডির আয়োজনে বৈঠক হয়েছে। এ সব বৈঠকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাছে বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। তাদের সমস্যার আলোকে তাৎক্ষনিক সমাধান দেয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। কাজের গুনগত মান নিশ্চিত করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ সব বৈঠক ফলপ্রসূ হলে বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আইএমইডি সূত্র জানায়, অর্থব্যয়ের হিসাবে ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বিদ্যুত বিভাগ। এ সময়ে ১১৩ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিভাগটি। বিদ্যুত বিভাগের আওতায় বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিদ্যুত বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার দাড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৫১ শতাংশে।
অবশ্য শতকরা হিসেবে বরাদ্দের সবচেয়ে বেশি অংশ ব্যয় করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ৪০ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ইআরডির ৫ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১০ মাসে বিভাগটির এডিপি বাস্তবায়নের হার দাড়িয়েছে ৮১ দশমিক ২০ শতাংশে। বরাদ্দের ২ দশমিক ২৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে তালিকার তলানীতে রয়েছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের ৫৭ মন্ত্রনালয় ও বিভাগের মধ্যে অর্থবছরের ১০ মাসে এডিপি বরাদ্দের অর্ধেক অর্থও ব্যয় করতে পারেনি এমন মন্ত্রনালয় ও বিভাগ রয়েছে ২৯ টি। এর মধ্যে সর্বাধিক বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রনালয় ও বিভাগের মধ্যে ৯ টির নাম রয়েছে।
১০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে শীর্ষ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রনালয় ও বিভাগের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রনালয়ের অবস্থান চতুর্থ। মন্ত্রনালয়টি ১০ মাসে আরএডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় করেছে ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। বিভাগের আরএডিপি বাস্তবায়ন হার দাড়িয়েছে ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশে। ৭ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে প্রাথমিক ও গন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অবস্থান ৬ষ্ঠ। এ মন্ত্রনালয় ১০ মাসে ব্যয় করেছে ৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা। এ হিসাবে বাস্তবায়ন হার দাড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে।
শীর্ষ বরাদ্দের তালিকায় সপ্তম অবস্থানে থাকা স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১০ মাসে আরএডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় করেছে ২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। বিভাগের আওতায় মোট বরাদ্দ আছে ৭ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১০ মাসে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন ৪০ শতাংশ। মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজে বিশেষ গুরুত্বের কারণে সেতু বিভাগে ৬ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বিভাগটি ১০ মাসে ব্যয় করেছে ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে বাস্তবায়নের হার দাড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৫৯ শতাংশে।
বাড়তি বরাদ্দ পাওয়া ১৫ শীর্ষ মন্ত্রনালয় ও বিভাগের মধ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ৪২ দশমিক ৯৫ শতাংশ, জ¦ালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয় ৪৭ দশমিক ২১ শতাংশ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ৪৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ২৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ, তথ্যযোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিভাগ বরাদ্দের ৩৬ দশমিক ৮২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এডিপি বাস্তবায়নের ধীর গতির বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সবসময়ই সুপারিশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ সময় মতো অর্থছাড় না হওয়া, জমির অধিগ্রহণে বিলম্ব, দক্ষ প্রকল্প পরিচালকের অভাব, বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব, কর্মকৌশল গ্রহণে সরকারের ধীর গতি, ক্রয়কাজে জটিলতা, যোগ্য পরামর্শক প্যানেল না পাওয়া, সংশ্লিষ্ট উন্নয়নসহযোগীর সম্মতি পেতে দেরি, পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়ে মূল্যায়নে জটিলতা, ঋণ নেগোশিয়েশন না হওয়া, সঠিক সময়ে বাস্তবসম্মত ক্রয় পরিকল্পনা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অনুসরণ না করা, দরপত্র আহŸান ও কন্ট্রাক অ্যাওয়ার্ড কাজে বিলম্ব, ভৌত কাজের ডিজাইন ও রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ না করা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা থেকে যথাযথ পরীবিক্ষণের অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন এবং বাস্তবায়নোত্তর আইএমইডির মনিটরিং প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে গুরুত্ব না দেওয়া, সময়মতো প্রকল্পের পিসিআর না পাওয়া ইত্যাদি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এডিপির বাস্তবায়ন শুধু টাকার অঙ্কে বিচার করলে হবে না। যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এডিপির প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তা সঠিকভাবে হয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। অন্যদিকে যারা বাস্তবায়ন করতে পারছে না, তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ