Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ঋণভারে দিশেহারা কৃষক

কুমিল্লায় সাড়ে ৪ হাজার প্রান্তিক কৃষকের নামে মামলা দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংক

| প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা থেকে : কুমিল্লার সাড়ে ৪ হাজার কৃষক এখন ঋণভারে জর্জরিত। তারা ফসল উৎপাদনে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। উচ্চ সুদ আর উৎপাদন খরচে তারা লাভ করতে পারছে না। ফসলে লোকসান দিয়ে তারা আবার ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা না থাকায় খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। বকেয়া আদায়ে কুমিল্লায় সাড়ে চার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দিয়েছে দেশের রাষ্ট্রায়াত্ত ৬টি ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেন, ঋণে উচ্চ সুদ, কমিশন বাণিজ্য, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ার কারণে কৃষি খাতে খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। এতে একদিকে ঋণ খেলাপির যন্ত্রণা, অন্যদিকে সার্টিফিকেট মামলার দৌরাত্ম্য, সব মিলিয়ে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগ থেকে সার্টিফিকেট মামলা নিষ্পত্তির জন্য জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত জেলা কৃষিঋণ কমিটিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। জেলায় কৃষিঋণ বিতরণে লিডিং ব্যাংকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।
কৃষি ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় কুমিল্লায় সাড়ে চার হাজার কৃষকের নামে সার্টিফিকেট মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। জেলার ১৭টি উপজেলায় ছয়টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে বিতরণকৃত ঋণের ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা আদায়ে মোট ৪৫ হাজারটি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়, শষ্য ঋণ, সেচ দেয়া ও সেচযন্ত্রপাতি ক্রয়, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়, পশুপালন, দারিদ্র্য দূরিকরণ, গবাদিপশু পালন, মৎস্য চাষ ও বিবিধ খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষক মাঝে ঋণ দিয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে সময় মতো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এ সব কৃষকের একটি অংশ খেলাপিতে পরিণত হয়। পরে এ সব কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা হয়। বিভিন্ন সময়ে জেলার ১৭টি উপজেলার ৬টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা ১২ কোটি ৪৮ লাখ ১১ হাজার টাকা আদায়ে, ৪ হাজার ৫শ ১৩ টি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করেছে কৃষকদের নামে । সোনালী, জনতা, অগ্রনী, রূপালী ও কর্মসংস্থান ব্যাংক ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আদায়ে ৪শ’ ৭৯ টি মামলা দায়ের করে। এছাড়া ১১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা আদায়ে কৃষি ব্যাংক করে ৪ হাজার ৩১টি মামলা ব্যাংকের পক্ষ থেকে জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার আদালতে এই ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
কৃষিঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ার সাথে সূত্রগুলো জানায়, কৃষিঋণ নেয়ার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষকরা দালালদের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে থাকে। এ সময় দালালরা ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে যায়। আবার কখনো কখনো অজ্ঞতার কারণে কৃষক নিজে ঋণ না নিয়েও স্থানীয় টাউট-বাটপার আর দালালরা ঋণ নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে দালালরা কৌশলে কৃষকের কাছে স্বাক্ষরও করিয়ে নেয়। আর এর সাথে ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুক্ত থাকে। পরে যখন ঋণ পরিশোধ করার সময় হয় তখন তারা বুঝতে পারে তার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঋণ নিয়ে ফসল বোনার পর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হয়। সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। খেলাপি হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সার্টিফিকেট মামলা পর্যন্ত গড়ায়। আর এর জন্য কৃষককে ঘরছাড়া হতে হয়। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সূত্র জানায়, শুধু কুমিল্লা নয়, দেশের সব অঞ্চলেই এ ধরনের মামলা হচ্ছে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক কুমিল্লা প্রিন্সিপাল অফিসের এসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার শাহিদা খানম বলেন, আমরা কৃষি/পল্লী ঋণ খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাদ্ধকৃত অর্থই কৃষকের মধ্যে বিতরণ করে থাকি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকি। এ ব্যাপারে আমাদেরকে জেলা, উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করে থাকেন। ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত সারকুলারে এর আলোকে ঋণগৃহিতাদের মামলা নিষ্পতির ব্যবস্থা করি। এ ক্ষেত্রে আমরা মানবিক দিকটিও বিবেচনায় রাখি। আমরা চাই ঋণ নিয়ে কেউ হেনস্থা না হন। ঋণগৃহিতাদের সাথে ঋণদাতার সুসর্ম্পক রাখতে আমরা সচেষ্ট থাকি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র দাবী করেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় না। কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ঋণ আদায় না হলে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায় করতে বলা হয়। যদি কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঋণের টাকা আদায় করতে না পারে, তাহলে তারা মামলা করার যে বিধান আছে তা অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে আদালত যদি মনে করে এই লোকটির কাছে থেকে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। বা লোকটি টাকা দিচ্ছে না। অথবা পাওয়া যাচ্ছে না তাহলে আদালত প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এ ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।
লাকসাম উপজেলার আমদুয়ার গ্রামের কৃষক আবদুল কাদের বলেন, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ, কৃষকরা ঋণ নিয়ে যখন পরিশোধ করতে পারেনা তখনই তাদের ঘাড়ে নেমে আসে সার্টিফিকেট মামলার খড়গ। অথচ বিত্তশালীরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছে। কৃষকের রক্তচোষা টাকায় বাড়ি গাড়ির মালিক হচ্ছে। এদিকে আমরা কৃষি পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছিনা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। যে কারণে ইচ্ছা থাকার পরও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারে না। এছাড়া ঋণ গ্রহণের সময় অনেক ক্ষেত্রে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের লোকদের বাড়তি টাকা দিতে হয়। আবার এসব ব্যাংক কর্মকর্তারাই কৃষকদের নেয়া ১০-২০ হাজার টাকা পরিশোধের দেরী হলে কিংবা পরিশোধ করতে না পারলে, তাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করান। তিনি আরও বলেন, ঋণ আদায়ে এদের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মানবিক আচরণ করা উচিত। তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলাগুলো তুলে নিয়ে ঋণের সুদ মওকুফ ও ঋণ মওকুফের দাবি জানান। জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার পানকরা গ্রামের কৃষক অজি উল্লাহ বলেন, সামান্য কৃষিঋণের টাকা পেতে দালাল ও ব্যাংকের লোকদের টাকা পয়সা দিতে হয়। ব্যাংকের এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে গত বছর আমরা বেশ কয়েকজন কৃষক একত্রিত হয়ে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদুল আরীফের নিকট অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু এর কোন সমাধান মেলেনি। তিনি আরও বলেন, সময়মতো কৃষি ঋণ পাওয়া যায় না বলে ঋণের টাকা অন্য খাতে খরচ হয়ে যায়। ঘরবাড়ির দলিল ব্যাংকে জমা রেখে নেয়া ঋণ কৃষক নানা সমস্যার কারণে সময়মতো পরিশোধ করতে পারে না। ঋণ গ্রহীতাকে সময় দিলে তারা অবশ্যই ঋণের টাকা পরিশোধ করবে বলেও দাবি করেন তিনি। এজন্য তিনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে মানবিক হওয়ার আহŸান জানান। তবে এসব প্রান্তিক কৃষকদের ঋণ মওকূপের দাবি জানিয়েছেন কৃষক লীগ নেতা ত্তমর ফারুক। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আলহাজ্ব ওমর ফারুকের মতে, ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ রেকর্ড কৃষকদের। এদিকে জেলা প্রশাসক বলছেন, ব্যাংকগুলো তাদের নিয়ম অনুযায়ী ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। অনেক কৃষক ঋণ নিয়ে মারা গেলেও, এখন মামলার বোঝা বইছেন তাদের পরিবার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ