Inqilab Logo

রোববার, ০৯ জুন ২০২৪, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বছরে ৪০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

পাহাড়ে সঙ্ঘাতের নেপথ্যে

| প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


চারটি সশস্ত্র সংগঠনের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে প্রতিবেশি ২টি দেশের প্রভাবশালী চক্র। সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছে ৩ হাজারেরও অধিক অত্যাধুরিক আগ্নেয়াস্ত্র। ৩৩৪টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ায় সন্ত্রাসের বিস্তার বাড়ছে
সাখাওয়াত হোসেন : চারটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টির সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, শান্তিচুক্তি নিয়ে মতভিন্নতা পার্বত্য তিন জেলায় অস্থিরতার নেপথ্যে কাজ করছে। এলাকা ভাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্রের মুখে সাধারন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি-বাঙালীদের জিম্মি করে বছরে আদায় করা হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকা। ইউপিডিএফ, জেএসএস, এমএন লারমা ও ইউপিডএিফ (গণতান্ত্রিক) এ চারটি আঞ্চলিক সংগঠনকে অবৈধ ভাবে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের যোগান দিচ্ছে প্রতিবেশী দু’টি রাষ্ট্রের প্রভাবশালী চক্র। পাহাড়ে অবস্থানরত ওই সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছে এম-১ কারবাইন, এম-১৬ রাইফেল, এম-৪, একে-৪৭ ও একে-২২এর মতো অস্ত্রসহ ৩হাজারেরও অধিক অত্যাধুরিক আগ্নেয়াস্ত্র রাখার তথ্য পেয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওই সূত্রগুলো জানিয়েছে, সন্ত্রাস দমনে পার্বত্যাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাবাহিনী যথেষ্ট তৎপর। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ৫৫২টি ক্যাম্পের মধ্যে ৩৩৪টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে ২১৮টি ক্যাম্প রয়েছে। বেশিরভাগ ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ার পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, অপহরন, দখল ও চাঁদাবাজি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। শান্তিপ্রিয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও বাঙালীরা চাঁদা দিয়েও এখন আর শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন না। প্রতিটি মুহুত তাদের কাটছে নিরাপত্তাহীনতায় মধ্যে। স¤প্রতি রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে আধিপত্য বিস্তারের বিরোধকে কেন্দ্র করে দুই দিনের ব্যবধানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পাহাড়ে নতুন করে আতংক দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে শিগগিরই যৌথ অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে স্থানীয় শান্তিপ্রিয় সাধারন বাঙালী ও ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্টির লোকজন মনে করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাথে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বান্দরবান, বাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সশস্ত্র সংগঠনের হাতে ১৩০জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও ৮৫জন বাঙালী নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন ২২৩জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও ৫৫১জন বাঙালী। অপহরনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৪০০ ও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে ১৩০টি। প্রায় ৫০০টি অস্ত্র ও ৭হাজার গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির একাধিক স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিপুল পরিমান চাঁদার টাকা নিয়ে দ্বন্ধ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। চাঁদা আদায় এবং এলাকার নিয়ন্ত্রন রাখতেই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে পাহাড়ে। ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে (জেএসএস) শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। এর এক বছরের মাথায় চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। মূলত তার পরেই পাহাড়ে আবারও ভ্রাতৃঘাতী রক্তের খেলা শুরু হয়। এরপর ২০০৭ সালে জেএসএস থেকে বেরিয়ে রূপায়ণ দেওয়ান-সুধাসিন্ধু খীসাদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। এতদিন ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এম এন লারমা) দুই সংগঠন অনেকটা এক হয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। কিন্তু গতবছরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আত্মপ্রকাশ করে পাহাড়ের চতুর্থ আঞ্চলিক দল। মূলত এই চার সংগঠনের ক্ষমতার বিস্তার, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের দ্বন্ধে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়।
গত এক দশকের পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইউপিডিএফের আধিপত্য খাগড়াছড়িতে বেশি। বালাঘাটা ও নাইক্ষ্যংছড়ির কিছু এলাকা বাদে বান্দরবানে আধিপত্য বেশি জেএসএসের। তবে রাঙামাটিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় দখল-পাল্টা দখল খুনোখুনির ঘটনা লেগেই রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি হঠাৎ করেই জটিল হয়ে উঠছে। আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বে চার ভাগ হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এ বিভক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙামাটির একজন চাকমা ব্যবসায়ী জানান, পাহাড়ে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই চারটি সংগঠন গড়ে ওঠেছে। চাঁদাবাজির কারণেই সশস্ত্র অবস্থায় গোটা পার্বত্য এলাকা তারা চষে বেড়াচ্ছে তারা।
রাঙামাটি জেলার একজন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতা বলেন, পাহাড়ে যৌথ অভিযানের সময় এখনই। একজন জনপ্রতিনিধিকে দিনে দুপুরে হত্যা করা এবং তার শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় আবার খুনের ঘটনা পাহাড়ে অস্থিতিশীলতার লক্ষণ। এমন অবস্থা এখানে বসবাসরত পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি কারোরই কাম্য নয়। স্থানীয় সূত্র মতে, রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকা হিসাবে পরিচিত বাঘাইছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, মারিশ্যা এবং লংগদু এলাকায় সন্ত্রাসীরা অনেকটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রয়েছে। যখন-তখন তাদের সক্রিয়তায় বাসিন্দাদের মধ্যেও ভীতি কাজ করে। পাহাড়ের চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের নামে অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেড়ে যাওয়ায় বাসিন্দারাও থাকছেন তটস্থ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ