Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

লাগামহীন আমদানি চাপে রিজার্ভ

| প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


অর্থনৈতিক রিপোর্টার : লাগামহীনভাবে বাড়ছে আমদানি। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ৫৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুই খাত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি যেভাবে বাড়ছে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় সেভাবে বাড়েনি। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দুই নির্দেশকের নি¤œমুখিতায় কমতে শুরু করেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর তাই আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। এদিকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল এবার ১৪০ কোটি ডলারে উঠেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মেয়াদে আকুর বিল রেকর্ড ১৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে উঠেছিল। গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে তিন হাজার ৩১২ কোটি (৩৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন) ডলার ছিল। আজ সোমবার অথবা আগামীকাল মঙ্গলবার আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১৪০ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার আকুর বিল পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে শোধ করা হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ২৯ লাখ (প্রায় সাড়ে ৩৩ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। কিন্তু এরপর আর তা খুব একটা বাড়েনি। বরং কমেছে। অথচ জ্বালানি তেলসহ বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের নিম্নমুখী দর কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ছিল আশীর্বাদ। একই সময়ে দেশের খাদ্য উৎপাদনেও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ওই সময়ে আমদানি ব্যয় কমায় বাড়তে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। যা আরও বাড়ার কথা থাকলেও গত কয়েকমাসে আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ সে অনুযায়ী বাড়েনি।
সূত্র মতে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ২৩০ কোটি ডলার। এরপর ২০১৫ সাল শেষে এর পরিমাণ ২ হাজার ৭৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ৩ হাজার ২০৯ কোটি ডলারে উন্নীত হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এভাবে বাড়ার কথা থাকলেও লাগামহীন আমদানীতে সেভাবে বাড়েনি রিজার্ভের পরিমাণ।
দেশে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর ধরেই নেতিবাচক চলতি হিসাবের ভারসাম্য (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স)। এর ধাক্কা লেগেছে রাষ্ট্রের ব্যালান্স অব পেমেন্টে। ফলে টান পড়েছে বাড়তে থাকা রিজার্ভে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেছেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ও ব্যালান্স অব পেমেন্টে। অনেক দিন ধরেই অর্থনীতির এ দুটি সূচক নেতিবাচক। এর প্রভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। কয়েক মাস ধরেই রিজার্ভ ৩১ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠানামা করেছে। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন থাকলেও আকুর বিল পরিশোধের ফলে এটি আবারো ৩১ বিলিয়নে নেমে আসবে।
আমদানি বিল এই হারে বাড়তে থাকলে রিজার্ভ চাপের মুখে পড়বে মন্তব্য করে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতি মাসেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, চলতি অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের আমদানি যে হারে হয়েছে সেই হারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। একই সঙ্গে রেমিটেন্স প্রবাহও কম। সব মিলিয়ে চলতি হিসাব ঋণাত্বক হয়ে পরেছে। এ লেনদেনে ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদি হলে তা অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেÑ আমদানি খরচ বাড়লেও পাশাপাশি রফতানি আয় সেই অনুপাতে না বাড়ায় ডলারের দামের অবমূল্যায়ন ঘটছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে ডলার বিক্রি করেই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঋণ শোধেও বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। অপরদিকে বেশি দরে পণ্য আমদানি করে ওই পণ্য আবার বেশি মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষকে ওইসব পণ্য চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট পাঁচ হাজার ৫৯৫ কোটি ৭৩ লাখ (৫৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। এই নয় মাসে এলসি নিষ্পত্তি (সেটেলমেন্ট) হয়েছে ৩৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। আর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এই নয় মাসে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-মার্চ সময়ে খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি বেড়েছে ২১৮ শতাংশ।
(জুলাই-এপ্রিল) এই সময়ে শুধু চাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৮৫ মেট্রিক টন। এই সময়ে আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ২৩৫ মেট্রিক টন চাল। এলসি’র চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ার কারণ পূর্বের এলসি হওয়া পণ্যের আমদানি এই সময়ে হয়েছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে ৩৭ শতাংশ, মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানিতে ৩৩ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর কাছে ৮৩ টাকা দরে ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ব্যাংকগুলো এই ডলার ৮৫টাকায় বিক্রি করছে। সবমিলিয়ে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দশ মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ৩ মে পর্যন্ত) ১৯৪ কোটি ৩০ লাখ (১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করে বা কেনে তাকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বলে। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে কিছু বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করে। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। কিনেছে ৮২ টাকা ৭৫ পয়সা দরে।

 



 

Show all comments
  • Shimu Monir ৭ মে, ২০১৮, ১:১১ পিএম says : 0
    মনে হয় লাগামহীন ভাবে আমদানির নামে রাগব বোয়ালরা দেশের টাকা বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ