Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুমিল্লায় ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

| প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা থেকে : কুমিল্লায় ভুল চিকিৎসা রোগীদের পিছু ছাড়ছে না। প্রতিনিয়তই ঘটে যাচ্ছে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু বা অঙ্গহানির ঘটনা। ডাক্তারদের অদক্ষতা বা অবহেলায় অহরহই প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার চান্দিনায় এক গাইনি ডাক্তারের অপচিকিৎসায় এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই নবাজাতকের মৃত্যু হয়েছে। পরে দুই নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা দোকান ঘরে থাকা ওই ক্লিনিকে ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে চান্দিনা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহত দুই নব জাতকের লাশ উদ্ধার করে এবং ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে ভুয়া গাইনি ডাক্তার কামরুন্নাহারের সহযোগী ইয়াসমিনকে (৩৫) আটক করে।
দুঃসহ যন্ত্রণা আর কষ্ট লাঘব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় থাকা ভুল চিকিৎসায় মানুষদের মিলছে ‘মৃত্যু’। অধিকাংশ ক্লিনিকেই নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসক, নেই সেবিকা, ওয়ার্ড বয়, সার্বক্ষনিক ক্লিনার। কিছু কিছু ক্লিনিকে শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম সাইনবোর্ড দেখা গেলেও কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখা মিলে না। রোগির সেবা নয় বরং ব্যবসা করার লক্ষ্যেই কুমিল্লার অনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে ক্লিনিক ও প্যাথোলোজিক্যাল সেন্টারগুলো। এসব ক্লিনিক গুলো জনগণের সাথে প্রতারণা ও সরকারের আইনের প্রতি বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে তাদের ক্লিনিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব ঘটনায় গত কয়েক বছরেও নেই কোন বিচারের নজীর। ঘটনা ঘটার সাথে সাথে শুধুমাত্র হসপিটাল বন্ধ ও গ্রেফতারের মাধ্যমেই মূল ঘটনার ইতি ঘটে যায়। এ সংক্রান্ত মামলার বেশিরভাগই আলো মুখ দেখে না। পরবর্তীতে স্বজনদের হাহাকার আর আহাজারী করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
জানা যায়, কুমিল্লায় প্রায় দেশ শতাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক রয়েছে। এসকল প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টারের মালিক পক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় যথাযথ কাগজপত্র না থাকার পরও রহস্যজনক ভাবে এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা এসব বাণিজ্যিক ক্লিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টারে কর্মরত নার্স, ব্রাদার, টেকনিশিয়ান, ল্যাব সহকারীদের অনেকরই যথাযথ প্রশিক্ষন সনদ নেই। অথচ এসকল প্রতিষ্ঠানের দালালরা সরকারী হাসপাতালের ভিতরে ও গেটে, বাস স্ট্যান্ডে অবস্থান নিয়ে রোগী নিয়ে টানা-হেঁচড়া করে। তাদের নির্দিষ্ট প্রাইভেট ক্লিনিক এবং ডায়গনষ্টিক সেন্টারে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কমিশন। এনিয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের সম্মুখে রোগী নিয়ে দালালে দালালে হাতাহাতি ও চুলোচুলির ঘটনা ঘটলেও স্বাস্থ্য প্রশাসন থাকে নিশ্চুপ।
কুমিল্লায় ইতিপূর্বে এক ভুয়া ডাক্তারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ১১ এপ্রিল কুমিল্লা মহানগরীর লাকসাম রোডের কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টার থেকে মাহবুবুর রহমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবু ফরহাদ (মাহমুদ) নামে একজন ভুয়া ডাক্তার জরুরী বিভাগ থেকে আটক করেন। আবার কোন কোন প্রাইভেট ডায়গনষ্টিক সেন্টার মালিকের বিরুদ্ধে তার পরিচালনাধীন ডায়গনষ্টিক সেন্টারে হাসপাতালের স্বনামধন্য চিকিৎসককে প্রাইভেট প্রাকটিস করার জন্য অনুরোধ করে বিফল হয়ে হুমকী-ধামকি দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এসকল প্রাইভেট কিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টার গুলোতে অবৈধ গর্ভপাতের অভিযোগও রয়েছে। গত ৫ মাসে কুমিল্লার বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে ভুল কিংবা অপচিকিৎসায় অন্ত্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। কুমিল্লার চান্দিনায় কথিত এক গাইনি ডাক্তারের অপচিকিৎসায় এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই নবাজাতকের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (৩ মে) বিকেলে চান্দিনা উপজেলার নবাবপুর বাজারে নবাবপুর মেডিকেল সেন্টার নামে একটি ক্লিনিকে এ ঘটনা ঘটে। তবে দোকান ঘরে ওই নামে সাইন বোর্ড থাকলেও কথিত ডাক্তার এর চিকিৎসাপত্রে ‘নাহার কন্সালটেশন সেন্টার’ নাম রয়েছে। এদিন উপজেলার বিচুন্দাইর-করইয়ারপাড়া গ্রামের প্রবাসী সফিকুল ইসলামের স্ত্রীর এবং কংগাই গ্রামের ওমর ফারুকের স্ত্রীর সিজারিয়ান প্রসব করান ওই ডাক্তার। দুজনেই ফুটফুটে দু’টি পুত্র সস্তান জন্ম দেন। দুই নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা দোকান ঘরে থাকা ওই ক্লিনিকে ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে চান্দিনা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহত দুই নব জাতকের লাশ উদ্ধার করে এবং ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে ভুয়া গাইনি ডাক্তার কামরুন্নাহারের সহযোগী ইয়াসমিনকে (৩৫) আটক করে।
নিহত এক শিশুর পিতা ওমর ফারুক দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আমার স্ত্রী প্রথম সন্তান ধারণ করার পর এলাকার লোকমুখে ডাক্তার কামরুন্নাহারের নাম শুনে তার কাছে প্রায়ই নিয়ে আসতাম। বুধবার বিকেলেও তিনি (কথিত ডাক্তার কামরুন্নাহার) আমার স্ত্রীর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে বলেন, আগামী দিন সকালে আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসতে। তার কথামত আমি বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে তার চেম্বারে নিয়ে আসি। সেখানে আনার পর তিনি আমার স্ত্রীকে ইজেকশন ও স্যালাইন দেয়। বিকেল অনুমান ৫টার দিকে আমার ছেলে সন্তান হয়েছে বলে আমাকে জানান। কিছুক্ষণ পর আবারও জানান, আমার স্ত্রীর সাইড সিজারে সন্তান ডেলিভারী হওয়ায় আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং আমার সন্তান মারা গেছে।
নিহত অপর শিশুর খালা কুলসুম জানান, আমার ছোট বোনের প্রসব ব্যথা শুরু হলে বৃহস্প্রতিবার সকাল ৯টায় আমরা কামরুন্নাহার ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে আসি। দুপুর অনুমান ২টায় আমার বোনের সন্তান প্রসব হওয়ার পর থেকে শিশুটির শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বিষয়টি আমার তাকে (কামরুন্নাহারকে) জানাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তার নাকি আপনরা ডাক্তার’ বাচ্চা ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই। ধিরেধিরে বাচ্চার স্বাস্থ্য আরো খারাপ হলে বিকাল ৪টার দিকে ডাক্তার কামরুন্নাহার আমাদের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই ইনজেকশনটি নিয়ে আসেন, আমাদের বাচ্চার অবস্থা ভাল না’ আমরা বাজার থেকে ওই ইনজেকশন এনে দিলে তারা ওই ইনজেকশনটি শিশুটির শরীরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু ঘটে তার। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে দুইটি বাচ্চার মৃত্যুর পর কামরুন্নাহার বলেন, ‘আমি একটু বাজার থেকে আসছি। আপনারা থাকেন’ এই কথা বলেই তিনি পালিয়ে যান। পরবর্তীতে কথিত ওই চিকিৎসক কামরুন্নাহারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে চান্দিনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানান, ঘটনাটি শুনে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছি। কথিত ডাক্তার কামরুন্নাহার আত্মগোপন করায় তাকে পাওয়া যায়নি তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার সহযোগীকে আটক করেছি। এ ঘটনায় নিহত শিশুদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুজিব রাহমান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে আমার আগে জানা ছিল না। এখন যেহেতু জেনেছি, ভুয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করবো। এদিকে গত ১লা এপ্রিল কুমিল্লা সদর উপজেলার বারপাড়া এলাকায় অপচিকিৎসায় সাড়ে তিন বছরের এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুর নাম শেখ ফরিদ। চিকিৎসার নামে তিন দিন অপচিকিৎসায় শিশুটি মারা গেলে সাদা কাফনে মোড়ানো তার লাশ বাড়িতে পাঠিয়ে ডাঃ কবিরাজ ফোন করে জানায়, জ্বিনে মেরে ফেলেছে সকালে, গোসল জানাজা হয়ে গেছে দাফন করে দিন। পরে বিকেলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। নিহত শেখ ফরিদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাড়িতে অতিরিক্ত দুষ্টুমি করে বলে শেখ ফরিদের মা তাকে চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ভাড়াপাড়া এলাকার কথিত কবিরাজ মাহাবুবুর রহমানের কাছে নিয়ে আসেন। কবিরাজ শিশুটিকে দেখে তিন দিনের জন্য তার কাছে রেখে যাওয়া কথা বলেন। কথামতো শুক্রবার সকালে শিশু শেখ ফরিদের মা চিকিৎসার জন্য তাকে কবিরাজের কাছে রেখে বাড়ি চলে যান। রাতে ফোন করে ছেলের খবর জানতে চাইলে কবিরাজ জানায়, ফরিদ ভালো আছে, তার চিকিৎসা চলছে, রোববার এসে নিয়ে যাবেন। সে এখন একবারে ভদ্র আর শান্ত, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরদিন দুপুর ১ টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে সাদা কাফনে মোড়ানো শিশু শেখ ফরিদের লাশ তার বাড়িতে নিয়ে যায় কবিরাজের খাদেম। আর ফরিদের মাকে কবিরাজ ফোন করে জানায়, জ্বিনে মেরে ফেলেছে সকালে, গোসল জানাজা হয়ে গেছে, দাফন করে দিন। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসায় মর্মান্তিক এ মৃত্যুর খবরে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এলাকায় লাশ নিয়ে আসা কবিরাজের খাদেম ও অ্যাম্বুলেন্সের চালককে কোতোয়ালী থানা পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী। রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ ডাক্তাররা রোগী দেখার সময় মাত্রাতিরিক্ত অবহেলা করে থাকে। যার ফলে এই অনাকাঙ্কিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তবে ডাক্তাররা বলেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা ও সেবাধর্মী যা মর্যাদাকর। আমরা সবসময় চেষ্টা করি রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে। কোন সময় চেষ্টার ক্রুটি রাখা হয় না।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ