Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মেঘ দেখলেই বিদ্যুৎ পালায়

০ অপরিকল্পিত লাইন স্থাপন ০ মান্ধাতা আমলের ট্রান্সফরমার

| প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা থেকে : কুমিল্লায় মেঘ দেখলেই বিদ্যুৎ পালায়। সামান্য বৃষ্টি আর বাতাস বইলেই চলে যায় বিদ্যুৎ। এমন দুরাবস্থা গত প্রায় ২০ বছর ধরে। বিদ্যুৎ গেলে এমনও হয়, কখনো ১৮ ঘণ্টা আবার কখনো ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা। গত সোমবার কুমিল্লার দাউদকান্দি ও তিতাস উপজেলায় কালবৈশাখী ঝড়ে দুই উপজেলায় কমপক্ষে ১৫ টি বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে যাওয়ায় ত্তইদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিদ্যুৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হত্তয়ার পর ত্তই এলাকার গ্রহকরা বিদ্যুৎ দেখেছেন পরদিন মঙ্গলবার রাত ১১ টায়, অর্থাৎ ৩৫ ঘণ্টা পর কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ মিলেছে। তাও উপজেলা সদরের কয়েকটি এলাকায়। তবে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ জিএম মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে বিদ্যুতের খুটি ভেঙে যাওয়া এবং কিছু এলাকায় তার ছিড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিদ্যুৎ যোগাযোগ পুরোপুরি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা কাজ করছে।
সূত্র জানায়, কুমিল্লার বিভিন্ন পৌর শহরসহ উপজেলার প্রায় সকল এলাকার বিদ্যুৎ লাইনগুলো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে এসব এলাকার ঝড়-বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। দাউদকান্দির এক স্কুল শিক্ষক আব্দুুর রহমান তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বৃষ্টি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে যায়। তা ছাড়া একটু দমকা বাতাস বইলে চার-পাঁচ ঘণ্টা এমনি কি কোন কোন সময় তিন-চারদিন বিদ্যুৎ থাকে না। এ যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। জানা যায়, কুমিল্লার প্রায় সব কয়টি উপজেলায় বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করলেও সংস্কার না হওয়ায় এগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। অনেক খুটি ও টাত্তয়ার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে যে সকল টাওয়ার রয়েছে সেগুলোও জং ধরে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। এর ফলে প্রবল বেগে বাতাস হলে ওই সব টাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক লাইনম্যান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, একটু বাতাস হলেই তারে তারে ঘষা লেগে তা জ্বলে যায় কিংবা ছিড়ে যায়। লাইন মেরামত না হওয়া পর্যন্ত ওই সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে দিনের পর দিন। হোমনা এলাকার হনুফা বেগম নামের একজন গৃহিনী বলেন, গত ৩০ এপ্রিল ঝড়ের পর থেকে তিন দিন যাবত তাদের ওখানে বিদ্যুৎ নেই রেফ্রিজারেটরে রাখা মাছ ও মাংস নষ্ট হয়ে গেছে। ইলিয়টগঞ্জ ড.মোশাররফ হোসেন ফাউন্ডেশন কলেছের একাদশ শ্রেনীর ছাত্র আমিনুল বলেন, ঝড়-বৃষ্টির অজুহাতে প্রায় সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এ কারণে আমাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। তবে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ জিএম মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ঝোড়ো হাওয়া বা বৃষ্টির আভাস পাওয়া গেলে নিরাপত্তার কারণেই লাইন বন্ধ করা হয়। ঝড়ে বৈদ্যুতিক তারের ওপরে গাছ ভেঙে পড়ায় গত তিন মাসে অনেকবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তার ছিঁড়ে গেলে, ঠিক করতে সময় লাগে। আসলে দূর্যোগের উপর কারো হাত নেই। এদিকে কুমিল্লার প্রায় ২০ বছরের পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের খুঁটি দিয়ে চলছে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। এ খুঁটিগুলো এমন ঝুঁকিপূর্ণ কুমিল্লায় সামান্য বাতাস-ঝড়-বৃষ্টি হলেই বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ খুঁটির কারণে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছেন গ্রাহকরা। একটু জোরে বাতাস শুরু হলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। কুমিল্লায় গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ। দিনে-রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকছে বিভিন্ন এলাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জরাজীর্ণ সরবরাহ লাইন, মান্ধাতা আমলের ট্রান্সফরমার এবং যখন তখন মেরামত কাজ করার কারণে ঝড়ের সময় বিদ্যুতের এই দুরবস্থা দেখা দেয়। কুমিল্লার গ্রাহকরা এখন আকাশে মেঘ দেখলেই বুঝেন বিদ্যুৎ চলে যাবে, কখন আসবে কেউ জানে না। এমনকি বিদ্যুৎ গেলে কখন আসবে সেই তথ্যও গ্রাহকদের জানাতে পারে না বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ চলে গেলে কুমিল্লা বিদ্যুৎ বিভাগের টেলিফোন বা মুঠোফোন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উঠায় না কেউ। আবু তাহের নামের একজন এডভোকেট দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মানুষের দুর্ভোগ আমলে নেয় না কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ গেলে আসবে কখন, এটি জিজ্ঞেস করার জন্য মানুষও পাওয়া যায় না, ফোন দিলেও ধরে না।
বিদ্যুৎ গ্রাহকদের অভিযোগ, বাড়িঘর, গাছ ও বাঁশবাগানের ওপর এলোমেলোভাবে অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য লোকসানের মুখে পড়েছে। ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, কুমিল্লায় ছোট বড় কয়েকশ’ শিল্পকারখানা রয়েছে। বর্তমানে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম। সামান্য বাতাস হলেই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। বিদ্যুৎ বন্ধ হলে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টায়ও আসে না। বিদ্যুতের নাজুক খুঁটির কারণে এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। মুরাদনগর এলাকার অপর ব্যবসায়ী এম এ রহিম বলেন, বৃষ্টি শুরুর পর বিদ্যুৎ বন্ধ করার কারণে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কাঠের খুঁটির কোনোটির গুঁড়ি নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই, কোনোটির মাঝখানে নষ্ট হয়ে গেছে, কোনোটি পুরোই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দেখা গেছে অনেক খুঁটি হেলে পড়েছে। এ ব্যাপারে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির-১ এর জেলারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কুমিল্লা -১ এর অফিসের আওতায় অনেক পুরনো কাঠের ঝুঁকিপূর্ণ খুঁটি রয়েছে। প্রায়ই বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনে মেরামত কাজ করতে হচ্ছে। এতে মাঝে মধ্যেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে লাইন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এটাকে লোডশেডিং বলা ঠিক হবে না। তবে শিঘ্রগিরই এগুলো পরিবর্তন করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন বিদ্যুৎ বিভাগের এ কর্মকর্তা। আবার কুমিল্লার কোথাও কোথাও ঘরের চাল আর ভবনের ছাদ ঘেঁষে ৩৩ হাজার ভোল্টের উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নেওয়া হয়েছে। মরিচা ধরা স্টিলের খুঁটিতে লাগানো এই ঝুঁকিপূর্ণ লাইন মাথার ওপরে রেখেই বসবাস করছে কুমিল্লার চান্দিনার বিভিন্ন আবাসিক এলাকার শত শত বাসিন্দা। এ ধরনের সংযোগ লাইনে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। বারবার আবেদন-নিবেদন করেও কোনো সাড়া পায়নি এলাকার বাসিন্দারা। ফলে ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। এ বিষয়ে জেলারেল ম্যানেজার বলেন, আমারা পর্যায়ক্রমে কাঠের কুঠিগুলো সরিয়ে ফেলবো। এব্যাপারে একটি প্রজেক্টও আসছে। আশা করছি আগামী দুই মাসের মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন হবে বলে আশাব্যক্ত করেন এই প্রকৌশলী। চান্দিনা মহিচাইল বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান জানান, সামান্য বৃষ্টি কিংবা বাতাস হলেই বিদ্যুৎ চলে যায় আর আসার খবর থাকে না। বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিলেই বলে লাইনের সমস্যা। এ অবস্থায় কিভাবে ব্যবসা বাণিজ্য চলতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লার প্রায় এলাকায় বিদ্যুৎ লাইনগুলো অনেক পুরনো হওয়ায় প্রায়শই লাইনের সমস্যা দেখা দেয়। আর তখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এ জেলার মানুষ। বছরের পর বছর বিদ্যুৎ নিয়ে এমন ভোগান্তি থেকে জেলাবাসীকে মুক্তি দিতে দ্রæত পরিকল্পিত ভাবে জেলায় পুরানো তারগুলো সরিয়ে নতুন করে বিদ্যুত তার টানানোর দাবি জেলা বাসীর।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ