Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুমিল্লায় সিএনজির চাকা ঘোরে না জিপি ছাড়া

বেপরোয়া চাঁদাবাজি নৈরাজ্যে জিম্মি সাধারণ মানুষ

| প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম


মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা থেকে : মালিক-শ্রমিকদের নামে বেপরোয়া ভাবে চলছে চাঁদাবাজি। কুমিল্লায় সিএনজি ও মেসি-মারতি’র (মিনি মাইক্রোবাস) চাকা ঘোরে না জিপি (চাঁদা) ছাড়া। নৈরাজ্যে জিন্মি সাধারণ মানুষ। মানা হচ্ছে না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়মনীতি। জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ কুমিল্লার জেলা-উপজেলার সিএনজি ও মেসি-মারতির স্ট্যান্ডগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মালিক-শ্রমিক সমিতির চাঁদাবাজি চলছেই। গত চার মাসে চাঁদা আদায়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে বেশ কয়েকবার সংঘাত হয়েছে। চাঁদাবাজির প্রতিবাদে চলতি বছরে কয়েকবার সিএনজি ও মেসি-মারতি চলাচল বন্ধ করে দেন চালকরা। সর্বশেষ গত ২২এপ্রিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় চলাচলরত মেসি-মারতি থেকে মহাসড়কের নিমসার এলাকায় চাঁদা আদায়ের প্রতিবাদে ধর্মঘট করে চালকরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে চাঁদাবাজি সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ক্রমেই তা মহাসড়কের বাসস্ট্যান্ডগুলোতেও ছড়াতে শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কমিটি করে দিয়ে চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। এতে করে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তী চরম আকার ধারন করে। কুমিল্লা জেলা মেসি-মারতি পরিবহন (সবুজ কার্ড বি-৯৩৮) এর পরিচালক মোঃ আজাদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা ক্যান্টারমেন্ট থেকে চান্দিনা পর্যন্ত প্রায় শতাধিক মেসি-মারতি পরিবহন চলাচল করে আসছে। গত কয়েকদিন ধরে মহাসড়কের নিমসার এলাকায় কুমিল্লা জেলা বাস ও মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের আওতাধীন নিমসার বাজার লিয়াজো অফিসের নামে প্রতি গাড়ী থেকে ৩০ টাকা করে চাঁদা আদায় করতে থাকে। কিছু চালক চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নিমসার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাসুদ রানা, নূরুল ইসলাম ও রতন এর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা চালকদের মারধর করে। এর প্রতিবাদে গত ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টা থেকে মেসি-মারতির প্রায় শতাধিক চালক মহাসড়কের কালাকচুয়া এলাকায় মহাসড়কের পার্শ্বে গাড়ী রেখে ধর্মঘট শুরু করে। এতে করে ওই রুটে চলাচলরত যাত্রীরা চরম ভোগান্তীর মধ্যে পরার খবরে ময়নামতি হাইওয়ে ক্রসিং থানা পুলিশের এস আই আলাউদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্সসহ ধর্মঘটের স্থলে পৌছালে চালকরা তাদের অভিযোগ পুলিশকে জানান। পরে দুপুর দেড়টায় আর চাঁদা দেয়া লাগবেনা পুলিশের আশ্বাসে চালকরা ধর্মঘট তুলে নিলে ওই সড়কে পুনরায় মেসি-মারতি চলাচল শুরু হয়। সরেজমিনে ঘুরে ও মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকাশ্য এই চাঁদার বাইরেও একজন সিএনজি ও মেসি-মারতি মালিককে দৈনিক গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলে না। সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কসহ কুমিল্লার বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী প্রায় সব সিএনজি ও মেসি-মারতি বিভিন্ন সমিতির অধীনে চলে। এসব সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। এদিকে জিপির নামে চাঁদাবজির কারনে কুমিল্লার শাসনগাছা-ব্রাহ্মণপাড়া সড়কে বাড়তি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে অভিযোগ সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীদের। তবে চালকদের অভিযোগ, জিপির নামে মালিক সমিতি ও স্ট্যান্ডের ইজারাদার চাঁদা আদায় করায় বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন তারা। অথচ স্ট্যান্ড ইজারাদাতা কর্তৃপক্ষ জেলা পরিষদ বলছে নির্ধারিত হারের অধিক টোল আদায় করা হলে ইজারা বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চালকদের অভিযোগ, শাসনগাছা-ব্রাহ্মণপাড়ার ২৩ কিলোমিটার সড়কে জিপির নামে প্রতিদিন সিএনজি প্রতি ৩৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তারা জানান, কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণপাড়ায় যেতে শাসনগাছা স্ট্যান্ড, পালপাড়া, ভরাসাল, বুড়িচং, চৌমুহনী ও বি-পাড়া স্ট্যান্ডে জিপির টাকা দিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক জানান, শুধু শাসনগাছা স্ট্যান্ডেই প্রতিদিন জিপি দিতে হয় ২৫০ টাকা। বুড়িচংয়ে ৩০, ব্রাহ্মণপাড়ায় ৩০, ভরাসার বাজারে ১০ ও বারেশ্বরে ১০ টাকা জিপি দিতে হয়। সব মিলিয়ে চালকদের শুধু জিপির টাকাই গুনতে হয় ৩৩০ টাকা। তাই তারাও বিপাকে রয়েছেন। কারণ, যাত্রী থাকলেও জিপির টাকা দিতে হয়, আবার না থাকলেও দিতে হয়। রুবেল, আলাআমিন, রোমান, জাহাঙ্গীর নামের যাত্রী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কয়েক মাস আগেও ব্রাহ্মণপাড়া রোডে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। তারপর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ১০ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখন কোন অজুহাত ছাড়াই যাত্রীপ্রতি ভাড়া দিতে হয় ৫০ টাকা। এতে তীব্র অসন্তোষ থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা। কিন্তু তা আরও অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকে সন্ধ্যার পর। তখন ভাড়া ৮০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের। তবে এ ব্যাপারে আমজাদ ও সাইফুল নামের দুই সিএনজি চালক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, হঠাত করেই কোন কারণ ছাড়াই আমাদের জিপি ৬০ টাকা থেকে করা হয় ১৩০ টাকা। অতিরিক্ত জিপি কমানোর জন্য আন্দোলন করেন চালকরা। কিন্তু তা না কমিয়ে উল্টো কয়েকজন চালককে জেলে নেওয়া হয় এবং জিপি নির্ধারণ করা হয় ২৫০ টাকা। আর এক্ষেত্রেও যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ৪০ টাকার স্থলে অতিরিক্তি ১০ টাকা। অন্যদিকে জিপি আদায়কারীদেরও গাড়ি প্রতি দিতে হয় ৫০ টাকা। এ নিয়ে প্রায় সময় যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের মারামারির ঘটনাও ঘটে। অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্তমানে এই রাস্তা দিয়ে চলতে হয় যাত্রীদের।
শাসনগাছা-ব্রাক্ষনপাড়া রোডে জিপি তোলেন মো. জুয়েল তিনি ইনকিলাবের কাছে দাবি করেন, তিনি ৩৫ টাকা চাঁদা নেন, এর বেশি নয়। এর বাইরে কে বা কারা বাড়তি জিপি আদায় করছে বলতে পারবো না। রাতে যাত্রী কম পাওয়ায় ভাড়া ১০ টাকা বাড়িয়ে নেওয়া হয়। তবে শাসনগাছা স্ট্যান্ডের সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি মফিজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান টিটু। তারা সমিতির নামে পালপাড়া স্ট্যান্ডে ৬০ টাকা জিপি আদায় করেন। এ প্রসঙ্গে আনিছুর রহমান টিটু বলেন, আমরা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের কল্যাণ তহবিল গঠন এবং তাদের অনুমতি ক্রমে দৈনিক ৬০ টাকা করে জিপি আদায় করি, যা চালকদের বিভিন্ন সুবিধা ও অসুবিধায় অর্থ দিয়ে সাহায্য করা হয়। আদায় করা জিপির টাকা থেকে চালকদের এই পর্যন্ত কি কি সুবিধা দেওয়া হয়েছে আনিছুর রহমান টিটুর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনও তথ্য দিতে পারেননি। তবে সিএনজি চালক আমাজদ ও সাইফুল বলেন, আদায় করা জিপির টাকা আমাদের কোনও উপকারে আসে না। গাড়ির মালিক-চালক ও হেলপাররা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ জেলার বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে চলাচলকারী সিএনজি ও মিনি মাইক্রোবাস ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি, চান্দিনা, মাধাইয়া, আমতলী, আলেখারচর,পদুয়ার বাজার,চৌদ্দগ্রাম সহ জেলার শাসনগাছা-ব্রাহ্মণপাড়ার সড়ক, চান্দিনা-দেবিদ্বার সড়ক, নিমসার-বরুড়া সড়ক, মাধাইয়া-নবাবপুর সড়ক, গৌরীপুর-হোমনা সড়ক, গৌরীপুর-মতলব সড়কে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা বিভিন্ন রোডে বিভিন্ন হারে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বলেন, প্রতিবছর জেলা পরিষদ বাস এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ডটি ডাকের মাধ্যমে ইজারা দেয়। ইজারা দেওয়ার সময় শর্ত দেওয়া হয় জেলার অভ্যন্তরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন একবার ১০ টাকা হারে টোল আদায় করতে পারবে। নির্ধারিত হারের অধিক টোল আদায় করা হলে ইজারা বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখবো। যাত্রী ও চালক হয়রানির প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ