Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শুরু : কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক

| প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

এ কে এম আব্দুল্লাহ, আজিজুল ইসলাম চৌধুরী ও মোঃ ফজলুর রহমান হাওরাঞ্চল থেকে : হাওর জুড়ে সোনালী ধান। যে দিকে চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। পাকা ধান শোভা পাচ্ছে চারিদিকে। ধান গোলায় তোলার স্বপ্নে বিভোর এ অঞ্চলের কৃষকরা। হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধানের ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে হাসির ঝিলিক। হাওর জুড়ে এখন পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ।
ধান কাটতে পেরে কতইনা আনন্দ দেখা দিয়েছে কৃষকের মনে। মনের আনন্দে ধান কাটছেন কৃষকরা। গেল বছর এ অঞ্চলের কৃষকরা হাওরে ধান কাটতে পারেনি। পারেনি গোলায় ধান তুলতে। মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের বৃষ্টিপাতে হাওরের বাঁধ ভেঙে পানিতে ডুবে যায় সকল ফসল। ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয় কৃষকরা। এবার ধান কাটা শুরু হওয়ায় মনে শান্তনা খোজার চেষ্টা করছেন তারা। এবার কৃষকরা ধান গোলায় তুলে মনের ক্ষত মেটানোর চেষ্টা করবেন। তবে ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারন করেছে। অনেক কৃষক শ্রমিক সঙ্কটের কারণে ক্ষেতের পাকা ধান কাটতে পারছেন না। শ্রমিক সঙ্কটের কারণে হাওরে ধান কাটা ব্যাহত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকুলে থাকায়, ধান ক্ষেতে রোগ বালাইয়ের প্রকোপ দেখা না দেয়ায় এবং কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছে কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বোরো মওসুমে নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ ও মদন উপজেলার বিভিন্ন হাওরে আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাত আগাম রোপন করায় এসব ধান পেকেছেও আগে। ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। গত বছর আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের কৃষকরা এক মুঠো ধানও গোলায় তুলতে না পারলেও চলতি মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপুতা হাওরে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা মনের আনন্দে ধান কাটছেন। মল্লিকপুর গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া জানান, ‘হাওরে ধান কাটা লেগেছে। আমি ১০ একর জমিতে ধান লাগাইছি, ৫ কাটা জমির ধান কাইট্যা বাড়িত আনছি’। হাওরের একাধিক কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা যায়, হাওরাঞ্চলের বেশীর ভাগ এলাকায় ধান কাটা শ্রমিক নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা। বিশেষ করে বড় কৃষকরা পড়েছেন বেকায়দায়। অগ্রিম টাকা দিয়েও ধান কাটা শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি করতে পারছেন না তারা। শেওড়াতলী গ্রামের কাঞ্চন মিয়া জানান, সকাল থেকেই কৃষকরা ধান কাটার যন্ত্র নিয়ে হাওরে যাচ্ছে। আর কৃষানীরা তাদের সোনালী ফসল গোলায় তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। তেতুলিয়া গ্রামের জব্বার মিয়া জানান, ধান কাটা শ্রমিক না পাওয়ায় নিজেরাই ক্ষেতের ধান কাটছেন। বিকালে মাড়াই মেশিন দিয়ে ধান মাড়াই করবেন। এবার কাটা প্রতি ৫/৬ মন ধান পাওয়া যাবে। বরান্তর গ্রামের জুয়েল মিয়া জানান, গত বছর ফসল হারিয়ে হাওরের কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। এবার ভালয় ভালয় ফসল ঘরে তুলতে পারলে কৃষকদের দুঃখ দুদর্শা লাঘব হবে।
নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মওসুমে নেত্রকোনা জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৮১ হাজার ৫ শত হেক্টর জমি। শেষ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯ শত হেক্টর জমি। জেলার হাওর উপজেলা হিসাবে চিহ্নিত খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা, আটপাড়া এবং বারহাট্টা উপজেলার কিয়দংশ এলাকাজুড়ে হাওরে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান রোপন করা হয়। ব্রি-২৮ জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। আর ব্রি-২৯ জাতের ধান আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যে কাটা শুরু হবে। কারণ ব্রি-২৯ জাতের ধান একটু উঁচু জমিতে লাগানো হয়েছে এবং এর ফলনও একটু দেরীতে হয়।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আক্তারুজ্জামান জানান, এবার নেত্রকোনায় হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষা জন্য ১৬ কোটে টাকা ব্যায়ে ৭৩টি পিআইসি’র মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
নেত্রকোনা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিলাশ চন্দ্র পাল বলেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবং সরকারের পক্ষ হতে ক্ষতিগ্রস্থ হাওরাঞ্চলের কৃষকদের কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি’র আওতায় উন্নতমানের বীজ, সার ও কীটনাশক বিনামূল্যে প্রদান করায় হাওরে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে আগাম বন্যা না হলে হাওরের কৃষকরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি ইতোমধ্যেই খালিয়াজুরী এবং মোহনগঞ্জের হাওর এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। বেশ কিছুদিন আগেই হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এসকল বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিং করায় এবার বাঁধের নির্মাণ কাজ অনেক ভাল হয়েছে।
হাওর বেষ্টিত হবিগঞ্জ সদর, বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই, নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলার একাংশ কৃষক পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস বোরো ধান। বছরের ৬ মাস কৃষি কাজ আর বাকী ৬ মাস হাওরে মাছ ধরা ও অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন হাওর পাড়ের ৮০ ভাগ লোক। এর আগে জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা ব্রি-২৮ জাতের ধান কেটে মাড়াই দিয়েছেন। এখন সব জাতের ধান পেকেছে। তাই ধান কেটে খলায় এনে মাড়া দিচ্ছেন কৃষকরা। কৃষান-কৃষানীদের ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে। কৃষকদের এখন একটাই চিন্তা ধান কাটা এবং মাড়া দিয়ে গোলায় তোলা। জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সোনা মড়ল হাওরে ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। উপজেলার শেখেরগাও গ্রামের গেড়স্থ সবুজ মিয়া বলেন এলাকায় বেশীর ভাগ গেরস্থ এবং কৃষকরা এবার ক্ষেতে ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ জাতের ধান লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, গেল বছর এক ফুঙ্গা (গোটা) ধান গোলায় তুলতে পারিনি। সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। গত বারের ভয়ে এবার আগাম জাতের ব্রি-২৮ ধান ক্ষেতে লাগিয়েছি। এখন ধান কাটতে পেরে মনে বেশ আনন্দ লাগছে। তিনি এ পর্যন্ত ৬ কেদার ব্রি-২৮ জাতের ধান কেটেছেন। এখন ব্রি-২৯ জাতের ধান কাটছেন। তিনি বলেন, এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট খুববেশী দেখা দিয়েছে। বেশী টাকা দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ধর্মপাশার সাংবাদিক সবুজ জানান, অনেক জমি আছে তার সোনা মড়ল হাওরে। বেশীর ভাগ জমিতে তিনি ব্রি-২৮ এবং কিছু জমিতে ব্রি-২৯ জাতের ধান লাগিয়েছেন। তিনি বলেন ব্রি-২৯ জাতের ধান এখন পাকছে। এ পর্যন্ত তিনি ৫ কেদার জমির ধান কেটেছেন। মহেশপুরের বড় গেড়স্থ দুলাল মিয়া জানান, এবার তিনি এ পর্যন্ত ব্রি-২৮ আগাম জাতের ৮ কেদার জমির ধান কেটেছেন। রাজিন্দ্রপুরের কৃষক আব্দুল গনি দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, দেড় কেদার জমির ধান কেটে মাড়া খলায় এনে মেশিনে মাড়া দিয়ে গোলায় তুলেছেন। এরই মধ্যে আরো ধান কাটতে পারবেন। দোয়ারা বাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের আছকির মিয়া জানান, এবার ধানের ফলনও ভাল হয়েছে। ধর্মপাশা উপজেলার টগার হাওর, ধারাম হাওর, কাইঞ্জা হাওরসহ অনকে হাওরে ইতোমধ্যে সব জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকার কৃষকরা। জামালগঞ্জের বৃহৎ শনির হাওর পারের মশলঘাট গ্রামের গেড়স্থ মাসুক মিয়া জানান, শনির হাওরের ধান পাকছে, কৃষকরাও ধান কাটছেন। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অনেকেই ধান গোলায় তুলতে পারবেন। তিনি বলেন এলাকার ছোট বড় সকল গেড়স্থরা শ্রমিক সঙ্কটে পড়েছেন। আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেপারী (শ্রমিক) ধান কাটার জন্য এলাকায় আসতো। এখন শ্রমিকরা এ এলাকায় না আসায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারন করেছে। ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা রোজ দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। জেলার বিভিন্ন হাওর পাড়ের কৃষকরা জানান, এ বছর ধানের ফলন বেশী হলেও শ্রমিকের সংখ্যা বাড়েনি। ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট এখনই দেখা দিয়েছে। আগে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দল বেধে শ্রমিকরা হাওড় পাড়ে ধান কাটার জন্য আসলেও গত কয়েক বছর ধরে অকাল বন্যায় বোরো ধান কাটতে ধান কাটার শ্রমিকরা আসতে চাচ্ছেন না। বেশী টাকা দিলেও রাজি হচ্ছেন না তারা। সুনামগঞ্জ সদর থানার ডাকুয়ার হাওর পাড়ের কৃষকরা বলছেন ইতোমধ্যে আগাম লাগানো ব্রি- ২৮ জাতের ধান কেটেছেন তারা। এখন হাওরে সব জাতের ধান কাটার ধুম পড়েছে। বিশ্বম্বরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের মেম্বার আব্দুল হেকিম বলেন বৃহৎ করচার হাওরে ধান কাটা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। কৃষকরা ব্রি-২৮ জাতের ও ব্রি-২৯ জাতের ধান কাটছেন। আর মাত্র কয়েক দিন। হাওরে সব জাতের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। তবে এবারও ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেক গেরস্থ শ্রমিক সঙ্কটের কারণে ধান কাটতে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। শ্রমিক সঙ্কটের কথা স্বীকার করে বানিয়াচং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ বশির আহমেদ বলেন, উপজেলার হাওরে ধান কাটা শুরু করেছে বিক্ষিপ্তভাবে। কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ হাওরের ধান কাটার উপযুক্ত হবে। শ্রমিক সঙ্কট নিরসনে আমরা বিভিন্ন প্রকল্প এলাকার শ্রমিকদের পুরো বৈশাখ মাস বোরো ধান কাটার কাজে আসতে বলেছি। তারা আসলে শ্রমিক সঙ্কট থাকবে না। স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার ১১ উপজেলায় এবার ২ লাখ ২১ হাজার ৭৫০ হেক্টর ভুমিতে বোর ধান আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন ধান। যার আনুমানিক মুল্য ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯২৪ কেটি ৬৭ লাখ টাকা। প্রতিটি হাওরে ধান পাকছে ধান কাটাও শুরু করেছেন কৃষকরা। তাদের মতে জেলার ১১ টি উপজেলায় ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ভাগ ধান কাটা হয়েছে। কৃষিবিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন আগামী কয়েকটি দিন আবহাওয়া ভাল থাকলে এ জেলার কৃষকরা তাদের কাঙ্খিত বোর ধান গোলায় তুলতে পারবেন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ