পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ইনকিলাব ডেস্ক : অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে প‚র্বের আইন বাতিল করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন তাতে, আসামের বিশাল সংখ্যক বাসিন্দার নাগরিকত্ব হারিয়ে দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশ’ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার পেছনে যেমন ভ‚মিকা রেখেছে আদালতের আদেশ, তেমন কাজ করেছে রাজনৈতিক সমর্থনও। একদিকে আদালত বলেছেন, সন্দেহভাজনদেরকেই তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে হবে। আর অন্য দিকে রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপি ভোটে জয়লাভের জন্য নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ‘বহিরাগতদের’ বাছাই করতে নাগরিকত্ব তালিকা হালনাগাদ শুরু করেছে। এর ফলে বিপাকে পড়েছে আসামে বসবাসকারী সব ধর্মের বাংলাভাষী মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে আসামে বসবাসরত প্রায় ৫০ লাখ বাংলাভাষী মানুষ যদি নাগরিকত্ব না পায় তাহলে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মতোই অবস্থা হতে পারে।
আসাম কি পরবর্তী রাখাইন হতে যাচ্ছে
ভারতের উত্তরপ‚র্ব অঞ্চলের আসামের রাজ্য সরকার জাতীয় নাগরিকত্ব তালিকা (এনআরসি) সম্প‚র্ণ করার পথে। আর মাস চারেকের মধ্যেই এই তালিকা চ‚ড়ান্ত হওয়ার কথা। এরই মধ্যে প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে অনেক বাংলাভাষী মানুষ বাদ পড়েছেন। ফলে আসামের বাঙালিদের রোহিঙ্গাদের মতোই দেশ ও নাগরিকত্বহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েছে। প্রথম তালিকায় কয়েক প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাসকারীদেরও নাগরিকত্বের তালিকায় নাম ওঠেনি। রাজ্য সরকারের দাবি, বাদপড়া আবেদনকারীদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তথ্যে ‘অসামঞ্জস্যতা’ পেয়েছেন তারা। মিয়ানমার রাখাইনে বসবাসকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রহীন করে দিয়েছিল ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের বলে। এবার নাগরিকত্ব আইনের বলি হতে পারেন আসামের বাসিন্দা বাংলাভাষীরা। আর বাংলাভাষীদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান।
নতুন নাগরিক তালিকায় নাম ওঠেনি আলতাফ হোসেনের। পেশায় দোকানদার আলতাফ বরাবরই জেনে এসেছেন তিনি ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু এখন তাকে বলা হচ্ছে, ভারত তাকে নাগরিক মনে করে না। তিনি জানতে পেরেছেন, সরকারের তৈরি নাগরিক তালিকায় তার নাম নেই। তিনি যে রাজ্যের বাসিন্দা, সেই আসামে তার মতো আরও অনেকের নামই ওঠেনি তালিকায়।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আসামের ধুবড়ি জেলার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, ‘প্রথম তালিকায় আমার নাম নেই। কর্তৃপক্ষ নাকি আমার পরিবারের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তথ্যে অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পেয়েছে। অথচ আমার পরিবার ১৯৪২ সাল থেকে ভারতে বসবাস করছে। আর এখন আমি হঠাৎ করে নাগরিকত্বহীন হয়ে গেছি।’
ইমতিয়াজ আহমেদ নামের এক কৃষকের অবস্থাও একই। তিনি জানিয়েছেন, তিনি যে জমির মালিক সেটার নথিতে তার দাদার আমলের তথ্যও রয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ যা বলছে তা মেনে নেওয়ার মতো নয়। তার ভাষ্য, ‘তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়টি নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই না।’ আলতাফ ও ইমতিয়াজের মতো আসামের প্রায় পঞ্চাশ লাখ বাংলাভাষী একই বিপদে পড়েছেন।
এরা তো তবু একেবারে সাধারণ মানুষ। নতুন তালিকায় ওঠেনি আসামের সংখ্যালঘুদের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দল ‘অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের’ (এআইইউডিএফ) মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল এবং রাধেশ্যাম বিশ্বাসের নামও। এই দুইজনের নাম ছাড়াও আসামের নতুন তালিকা থেকে বাদ পড়েছে দলটির আরও কয়েকজন নেতার নাম। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার নামও বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও ভারতের মুম্বাইভিত্তিক সুগন্ধি ব্যবসার মালিক বদরুদ্দিন আজমল এআইইউডিএফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২০০৬ সালে। রাধেশ্যাম বিশ্বাস এই দল থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
আসামের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘এনআরসিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য জমা পড়া আসামের ৪৮ লাখ বাসিন্দার আবেদনপত্রে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তথ্যে অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে। এসব আবেদনকারীদের বা এদের মধ্যে বেশিরভাগ আবেদনকারীদেরই নাগরিক তালিকায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওই তালিকা প্রকাশের জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। প্রায় ২ কোটি নাগরিকের তথ্য যুক্ত খসড়া তালিকাটির প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছিলেন আসামের ৩ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দা। এসব আবেদনকারীর মধ্যে এখনও ১ কোটি ২৮ লাখ আবেদনকারীর নাম তালিকাতে ওঠেনি। যাদের নাম চ‚ড়ান্ত তালিকায় আসবে না, তাদের নাগরিকত্ব থাকবে না। আসামের জন্য প্রথম নাগরিকত্বের তালিকা তৈরি হয়েছিল ১৯৫১ সালে। আসামের ৪৫ শতাংশ বাসিন্দাই বাঙালি, যারা সংখ্যায় অসমীয়দের চেয়েও বেশি। এর কারণ, আদিবাসী বাসিন্দারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে নিবন্ধন করিয়েছে , অসমীয় ভাষাভাষী হিসেবে নয়।
গত কয়েক দশক ধরে বাঙালি ভাষাভাষীদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। যার ফলে ‘বাঙালি বনাম অসমীয়’ মতো বিভাজনম‚লক ধারণা আসামের রাজনীতিতে গেড়ে বসেছে। অনেক বছর ধরেই আসামে ‘বহিরাগতদের’ বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন চলছে। প্রাথমিকভাবে ওই আন্দলোনের লক্ষ্য ছিল নৃতাত্তি¡কভাবে যারা অসমীয় নয় তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন ‘বহিরাগত’ বলতে ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী’ বোঝানো হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই ‘বহিরাগতবিরোধী’ প্রচারণাকে ব্যবহার করেই ২০০৬ সালে রাজ্যটিতে ক্ষমতাসীন হয়। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘বহিরাগতদের’ কারণে আসামের পরিচয় ‘বিনষ্ট’ হওয়া রুখতে তারা জাতীয় নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগাদ করবে। আর হয়েছেও তাই। হালনাগাদ করা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন বাংলাভাষীরা।
‘ইলিগ্যাল মাইগ্রেন্টস ডিটারমিনেশন বাই ল’ বা আইএমডিটি নামের অবৈধ অভিবাসী সংক্রান্ত আগের যে আইনটি ছিল তাতে বলা হয়েছিল, যতক্ষণ না পর্যন্ত অবৈধ হিসেবে প্রমাণিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। কিন্তু ২০০৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওই আইনের সেই ধারাটি উল্টে দিয়েছে, যার ভিত্তিতে চালু থাকা জাতীয় নাগরিকত্ব হালনাগাদ প্রকল্প এখন লাখ লাখ মানুষের ঘর ছাড়া হওয়ার দশা করেছে । অবৈধ অভিবাসী সংক্রান্ত নতুন আইনে বলা হয়েছে, যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সরকার নিশ্চিত নয়, তাদের নিজেদেরই নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে হবে।
আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামের যে এনজিওটির আবেদনের ভিত্তিতে আদালত ওই আদেশ দিয়েছিলেন সেটির সভাপতি অভিজিৎ শর্মা বলেছেন, ‘আদালতের দেওয়া স্পষ্ট রায় অনুযায়ী কাজ করা ছাড়া সরকারের আর কোনও পথ নেই।’ আগের আইন বাতিল করা ও নতুন করে নাগরিকত্বের তালিকা প্রণয়নে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া আদেশকে স্বাগত জানিয়েছিল আসামের বাঙালিবিরোধী দলগুলো। এসব দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সোচ্চার ছিল অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ)। যারা ১৯৭৮-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ‘বহিরাগতদের’ বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন করেছে। এএএসইউয়ের উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশ থেকে আসা ‘জনতাত্তি¡ক আগ্রাসনের’ শিকার অসমীয়দের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে।”
কিন্তু যে রায় নিয়ে তারা খুশি, সেই রায় আতঙ্ক তৈরি করেছে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়া লাখ লাখ মানুষের মনে। বাংলাভাষী রাজনীতিবিদ হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, ‘আইএমডিটি আইন বলবৎ থাকাকালে আসামের রাজনীতিবিদ ও পক্ষপাতম‚লক আচরণ করা আমলাতন্ত্রের জন্য আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া কঠিন ছিল। সেই আইনটি বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের অবস্থা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো হয়েছে। রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী মনে করা হয়।’
কলকাতাভিত্তিক রিসার্চ গ্রæপের প্রধান আনিতা সেনগুপ্তা বলেছেন, ‘যদি আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দারাই নাগরিকত্ব বঞ্চিত হয়, তাহলে রাখাইনে যেরকম শরণার্থীদের ঢল দেখা গিয়েছিল আসামেও আমাদের সেরকম শরণার্থীদের ঢল দেখতে হতে পারে। একই রকম মানবিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে সামনে।’
বাংলাভাষী যে ৪৮ লাখ আবেদনকারী এখনও বংশ পরম্পরায় আসামের বাসিন্দা হওয়ার প্রমাণ হাজির করতে পারেননি, তাদের রোহিঙ্গাদের মতো শরণার্থী হয়ে ওঠার আশঙ্কার দিকে ইঙ্গিত করে রাজ্যটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক উৎপল বরদলই প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আসাম কি পরবর্তী রাখাইন হতে যাচ্ছে?’ স‚ত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।