Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উৎস বন্ধ না হলে ঠেকানো যাবে না নেশার এ ভয়াল আগ্রাসন

চট্টগ্রামে দিনে মাদকের ১১ মামলা

| প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৯৫টি। এরমধ্যে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় মামলা ৩৭৪টি। আর মাত্র ২১টি মামলা হয়েছে খুন অপরহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। জানুয়ারিতে নগরীর ১৬টি থানায় ৩৬১টি মামলার ৩৭৪টিই ছিল মাদকের। অন্যান্য অপরাধের ঘটনায় মামলা হয় মাত্র ৯টি। পুলিশের এ পরিসংখ্যান বলছে চট্টগ্রামে অপরাধের শীর্ষে এখন মাদক ব্যবসা। এখানে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় দিনে ১১টির বেশি মামলার রের্কড হচ্ছে। গতবছরে নগরীতে চার হাজার ৫৩৭টি মামলা রের্কড হয় যার মধ্যে চার হাজার ২৬০টি ছিল মাদক মামলা।
র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানে প্রতিদিনই নগরীতে মাদকদ্রব্যসহ মাদক ব্যবসায়ী বা বহনকারী ধরা পড়ছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, পুলিশ তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিচ্ছে। এসব মামলায় অনেকের সাজাও হচ্ছে। তবে এতকিছুর পরও বন্ধ হচ্ছে না মাদক ব্যবসা। সীমান্ত পথে আসা ইয়াবাসহ মাদকের ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে যুবসমাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎস বন্ধ করা না গেলে এসব অভিযানে মাদকের ভয়াল আগ্রাসন প্রতিরোধ করা যাবে না। এর পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে দেশে মাদকের চাহিদা কমিয়ে আনতে হবে।
সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও মাদকের রাজা এখন ইয়াবা। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নারীরাও ইয়াবার নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। মহানগরীর মাদকের হাট হিসেবে পরিচিত প্রতিটি এলাকায দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। যেখানে অভিযান সেখানে ধরা পড়ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। ইয়াবা আসছে প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার থেকে। গেল বছরের আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে মিয়ানমার সীমান্তে সেদেশের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী কড়া নিরাপত্তা জোরদার করলেও এদেশে ইয়াবা ঠেলে দেওয়ায় কোন হেরফের হয়নি। এখনও মিয়ানমার থেকে আসার পথে স্থল ও সমুদ্রপথে ইয়াবার বড় বড় চালান ধরা পড়ছে। গত শুক্রবার ৫৪ কোটি টাকা মূল্যের ১৮ লাখ ইয়াবার চালান উদ্ধার করে বিজিবি।
র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে প্রতিদিনই নগরীতে ইয়াবার ছোট-বড় চালান ধরা পড়ছে। র‌্যাব-চট্টগ্রামের অভিযানে গত বছরের প্রথম দিন থেকে চলতি বছরের ১৬ মার্চ পর্যন্ত ৭৬ লাখ ৭৭ হাজার ২৭৮ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে। গেল পাঁচ বছরে বিজিবি দক্ষিণ-পূর্ক্ষ রিজিয়নের অভিযানে উদ্ধার হয় তিন কোটি ১১ লাখ চার হাজার ৮১১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা পুলিশের পাশাপাশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও নিয়মিত ইয়াবা উদ্ধার করছে। এছাড়া নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের অভিযানেও ধরা পড়ছে ইয়াবার বড় চালান। লাভজনক ইয়াবা ব্যবসাকে ঘিরে গড়েউঠা সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক কোনভাবেই ভাঙ্গা যাচ্ছে না। এর সাথে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য জড়িয়ে পড়ায় ইয়াবার আগ্রাসন এখন অনেকটা অপ্রতিরোধ্য।
এ অঞ্চলে ইয়াবার পরেই রয়েছে ফেনসিডিলের অবস্থান। র‌্যাব পুলিশের অভিয়ানে নিয়মিত ধরা পড়ছে ফেনসিডিল। ভারত থেকে সীমান্ত পথে আসা এই মাদক বিক্রি হচ্ছে নগরীতে। র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অভিযানে প্রতিনিয়তই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনসিডিলের চালান ধরা পড়ছে। যাত্রীবাহি বাস, প্রাইভেট কার, পণ্যবাহি কাভার্ড ভ্যানে লুকিয়ে নানা কৌশলে মাদক ব্যবসায়ীরা এসব চালান নিয়ে আসছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাভার্ড ভ্যানে করে আনা কয়েকটি চালানও ধরা পড়ে র‌্যাবের হাতে। র‌্যাব পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবার মতো ফেনসিডিলের চোরাচালানও বাড়ছে। এক বছরে র‌্যাবের অভিযানে ৩৬ হাজার ৬৩১ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। ভারত থেকে ফেনসিডিলের সাথে আসছে গাঁজাও। এক বছরে র‌্যাব ৯২৩ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে।
র‌্যাব পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, নগরীতে প্রতিদিনের অভিযানে ইয়াবা এবং ফেনসিডিলের চালান ধরা পড়ছে। এই দু’টি মাদকের চাহিদা বেশি। তবে যে পরিমান মাদক ধরা পড়ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চালান নিরাপদে গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। মাদকের আগ্রাসনে আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধ প্রবণতাও। মাদকের ব্যবসাকে ঘিরে অপরাধীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সংঘাত-সহিংসতা এবং খুনের ঘটনাও ঘটছে। মাদকাসক্তির কারণে বাড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন) কুসুম দেওয়ান বলেন, মাদক প্রতিরোধকে পুলিশ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আর এই কারণে নিয়মিত অভিযানে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। মাদক ব্যবসা নিয়ে নানা অপরাধও হচ্ছে। তবে শুধুমাত্র অভিযান চালিয়ে এই আগ্রাসন বন্ধ করা যাবে না। ইয়াবা ও ফেনসিডিলের মতো মাদক আমাদের দেশে তৈরী হয় না। যেখান থেকে এসব মাদক আনা হয় সেই উৎস বন্ধ করতে হবে। সীমান্ত পথে এসব মাদকের চালান আটকাতে হবে। সেই সাথে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি। দেশে চাহিদা কমে গেলে মাদক আসা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত ইয়াবা ও ফেনসিডিল পাচার বন্ধে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর অংশ হিসাবে বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে উঠা ইয়াবার কারখানা ও ভারত সীমান্তের ফেনসিডিল কারখানা বন্ধে দুই দেশের প্রতি আহŸান জানানো হয়। বিজিবির একজন কর্মকর্তা জানান, সীমান্ত বৈঠকেও এবিষয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষিদের সাথে আলোচনা হয়। ভারত কিছু ফেনসিডিল কারখানা বন্ধও করেছে। তবে মিয়ানমার ইয়াবা কারখানা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। সরকার এই লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলেও জানান ওই বিজিবি কর্মকর্তা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ