Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঘটছে কৃষি জমির স্বাস্থ্যহানি

অর্গানিকের বদলে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহার বেড়েছে বহু গুণে

| প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : নিকট অতীতের চেয়ে দেশের সবখানেই আবাদী জমির ব্যবহার ন্যুনতম ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ফসলীর চেয়ে আবাদ হচ্ছে তিন ফসলী। আবার সাথী ফসল হিসেবেও অনেক জমিতে একসাথে একাধিক ফসল উৎপাদন হচ্ছে। এতে মাটিতে সহ্য ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ছে। কিন্তু মাটির চাহিদানুযায়ী খাদ্য সরবরাহ হচ্ছে না। মানবদেহের হার্টের মতো কৃষি জমির মূল প্রাণ অর্গনিক মেটার। বর্তমানে অর্গানিক ফার্টিলাইজারের চেয়ে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের আধিক্য বেড়েছে বহুগুণে। যার জন্য ক্রমাগতভাবে মাটি হারাচ্ছে উৎপাদন ক্ষমতা। গুণগত মানও হ্রাস পাচ্ছে দ্রæত। স্বাস্থ্যহানি ঠেকানোর ব্যবস্থা নেই। নিরববিচ্ছিন্নভাবে শুধু ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে না মাটির বিশ্রাম। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থার ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞগণ। তা না নিলে নিকট ভবিষ্যতে কৃষি জমির ভয়াবহ সর্বনাশ ঘটবে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট সুত্রে জানা গেছে, দেশের কোথাও কোথাও মাটিতে জৈব পদার্থের গড় পরিমাণ শতকরা শূন্য দশমিক-১ এ নেমে এসেছে। সূএমতে, মাটিতে ফসফরাস, নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, গন্ধক, দস্তা ও বোরণসহ শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে ৩ দশমিক ৪৪ ভাগ জৈব পদার্থ থাকলেই মোটামুটি উপযুক্ত হিসাবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ এলাকার মাটিতেই এখন আর আগের মত অতি উচ্চ জৈব পদার্থ নেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শূন্য দশমিক ১ থেকে ১ দশমিক ৭ ভাগ পর্যন্ত জৈব পদার্থ বিদ্যমান। উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘাটতি রয়েছে নাইট্রোজেন। মাটির অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে ভৌত, রাসায়সিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্য প্রধানত। এর কোনটিই পরীক্ষা করে ফসল উৎপাদনের জন্য মাটি ব্যবহৃত হয় না। তাছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারীভাবে জোরদার কোন ব্যবস্থাপনা নেই বললেই চলে। যার কারনে সারাদেশে গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষি জমি উর্বরাহানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শ সরকারকে এজন্য বহুমুখী পরিকল্পনা নেয়া জরুরী। তাতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হবে। উৎপাদন আরো বাড়বে।
এক সমীক্ষার রিপোর্ট উদ্বৃত করে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি স¤প্রসারন অধিদপ্তর, বিএডিসি ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সূত্রগুলো জানায়, আবাদী জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিশেষ করে নকল ও ভেজাল সার প্রয়োগ এবং পাল্লা দিয়ে আধিক ফসল ফলানোর কারণে মাটি উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে। দ্রæত হ্রাস পাচ্ছে মাটির গুণগত মান। এজন্য ভেজাল সারের ব্যবহার বন্ধ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত, মাঠে মাঠে জৈব ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, ছোলা, মসুর, মাসকলাই, মুগ, খেসারী, মটরশুটি ও অড়হরসহ ডালজাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক নিয়মে জৈব পদার্থ তৈরীর ব্যাপারে জোর দেওয়া দরকার। সুত্রমতে, শুধু গতানুগতিক ধারায় মাটি পরীক্ষা নয়, কোন এলাকার মাঠে কি পরিমাণ উপাদান ঘাটতি রয়েছে কিভাবে সমাধান করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সুত্রমতে, ঘাটতি হচ্ছে সাধারণত আবাদী জমির খড়কুটা ও ডালপালাসহ প্রাকৃতিক নিয়মে জৈব পদার্থ তৈরীর উপকরণ শিকড় পর্যন্ত তুলে নেয়ার কারণে।
মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউটের সুত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাটি জরিপের রিপোর্ট হচ্ছে, আবাদী জমির মাটিতে অর্গানিক মেটারের ঘাটতি রয়েছে। উচু এলাকা অর্থাৎ ডাঙ্গা জমিতে সবচেয়ে বেশী ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিল এলাকার জমিতে ঘাটতি কম রয়েছে। বিল এলাকায় খড়-কুটা, কুচরীপনা ও ডালপালা পচে আনাআপনিই জৈব সার তৈরী হয় জমিতে। ডাঙ্গা জমিতে একের পর এক ফসল উৎপাদন এবং বেশী ফলনের আশায় মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এতে তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়া গেলেও জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাবার আশংকা প্রবল হচ্ছে। কারণ মাটির ভেতরের উপকারী পোকা-মাকড় ধ্বংস হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশের ৭টি এগ্রিকালচার ইকোলজিক্যাল জোনে মোট ৩০টি ফিজিওগ্রাফী ইউনিটের মাধ্যমে মাটি জরিপ হয়েছে। এর বাইরে ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমেও জরিপ চলছে। আবার অনেকস্থানে রি-সার্ভের কাজও চলছে। বেশীরভাগস্থানের জরিপ রিপোর্টে উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে আসছে। তা হলো কৃষি জমির মাটিতে অর্গানিক মেটারের ঘাটতি। সুত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বগুড়া ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নকল ও ভেজাল সারের কারবার চলছে। যশোর অঞ্চলে তো দস্তা সারের নামে পোড়া মাটি ও ব্যাটারীর ছাই পর্যন্ত ঝকঝকে প্যাকেটে প্যাকিং করে বাজারজাত করার ঘটনা অসংখ্যবার ধরা পড়েছে। তাছাড়া রক ফসফেট, ডলামাইট ও ম্যাগ সালফেটসহ নানা ধরনের সার যা আবাদী জমিতে ব্যবহারযোগ্য নয়, তাও ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল সার মাটির জৈব পদার্থের প্রধান শত্রæ। তাতে মাটি শক্ত হয়ে নিউট্রেন সাপ্লাইাই বন্ধ হয়ে যায়। কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সময় থাকতে কৃষি জমির অর্গানিক মেটার পুনরুদ্ধারে জোরদার ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তা না হলে কৃষি সেক্টরের সর্বনাশ ঘটার আশঙ্কা থাকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ