Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যেখানে লুকানো প্রশ্ন ফাঁসের রহস্য...

| প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মাহফুজ মন্ডল, দিনাজপুর থেকে : এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে বেকায়দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ সচেতন মহল। প্রতি পরীক্ষায় আটক হচ্ছে পরীক্ষার্থী, শিক্ষকসহ পরীক্ষার্থীর সতীর্থরা। কিন্ত প্রশ্ন ফাঁসকারীরা দমছে না বরং দাপটের সাথেই প্রশ্ন ফাঁস ও সরবরাহের কাজটি করে যাচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁস রোধ না হওয়ায় ভুক্তভোগী পক্ষের আবেদনে সাড়া দিয়ে হাইকোর্ট দুটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে দিয়েছে। অনেকে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে। প্রশ্ন ফাঁসকারী হোতাদের কেউ সনাক্ত করতে পারছে না কেন? শুধু এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুজতে যেয়ে পাড়ী দিতে হবে বিজি প্রেস থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র পর্যন্ত। কেননা বিজি প্রেস থেকে কেন্দ্র অনুযায়ী প্যাকেট ও ট্রাঙ্কজাত হয়ে সর্বশেষ এক থেকে দেড় ঘন্টা আগে কেন্দ্রে পৌছে প্রশ্ন পত্র। তাই এই পথ এবং পরীক্ষা শুরুর আগে পর্যন্ত কার্যক্রমগুলিকে ভালভাবে পর্যালোচনা করলেই মিলে যেতে পারে প্রশ্ন ফাঁসের রহস্য। যদিও প্রশ্ন ফাঁসকারীর হোতারা অধরাই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলেই সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলি দাবী করেছে। প্রশ্ন ফাঁস রোধে সকল প্রচেষ্টাকে নড়ে বড়ে করে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে দৈনিক ইনকিলাব এর পক্ষে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান, কেন্দ্র সচিব থেকে পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সাথে আলোচনা করে পর্যালোচনামূলক রিপোর্টটি তৈরী করেছেন আমাদের দিনাজপুর আঞ্চলিক প্রধান মাহফুজুল হক আনার।
দেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এর অধীনে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডসমুহের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শায়ত্বশাষিত হলেও বোর্ডসমূহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রেষনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকে চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপ ও সহকারী সচিব, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ দায়িত্বশীল ৬ থেকে ৭ টি পদে। অন্যান্য সকল পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক মূলত বোর্ডগুলি’র কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে স্বায়ত্বশাসিত হওয়ায় আন্তঃবোর্ড-এর কিছু কিছু সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হয়ে থাকে বোর্ডগুলিতে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড দিনাজপুরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, পরীক্ষার খাতা তৈরী করে সরবরাহ, উত্তরপত্র মূল্যায়নের সকল কার্যক্রম সম্পন্নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বোর্ডের। প্রশ্নপত্র তৈরী’র ক্ষেত্রে বিজি প্রেসে কাগজ, খাম প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহের পাশাপাশি সকল খরচ বহন করে শিক্ষা বোর্ডসমূহ।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে মুঠোফোনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান মোঃ আবু বকর সিদ্দিক দায় এড়ানো যায় না উল্লেখ করে বললেন, প্রশ্নপত্র তৈরী থেকে কেন্দ্রে সরবরাহ এবং প্যাকেট খুলে পরীক্ষা গ্রহণ পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডের সরাসরি কোন সংযোগ থাকে না। তবে নীতিমালা মোতাবেক তদারকি থাকে। তিনি বলেন, সরকারী মুদ্রণালয়ে (বিজি প্রেসে) প্রশ্নপত্র মুদ্রণের পর প্যাকেটবন্দি করা পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডের কেউ প্রশ্ন দেখার সুযোগ পায় না। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে প্যাকেট করা প্রশ্নপত্রসমূহ ট্রাংকে ভরে সীলগালা ট্রাংকসমূহ দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মূলত এখানেই বিজি প্রেস ও বোর্ড প্রতিনিধিদের সাথে প্রশ্ন পত্রের সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর জেলা’র ট্রেজারি ও উপজেলার থানা বা ব্যাংকের লকার যেটাকে প্রশাসন নিরাপদ মনে করে সেখানেই পরীক্ষার আগে পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়।
দীর্ঘ কয়েক বছর পরীক্ষা গ্রহণের সাথে একজন কেন্দ্র সচিবের সাথে কথা বললে তিনি জানান, পরীক্ষা গ্রহণের এক থেকে দেড় ঘন্টা আগে ট্রেজারী, থানা অথবা ব্যাংকের লকারে নিরাপদে রাখা প্রশ্ন পত্রের প্যাকেট ভর্তি ট্রাংক সরবরাহ করা হয়। এসময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কড়া নজরদারীতে প্রশ্ন গ্রহণকারীদের রাখা হয়। এরপর তিনি যা বললেন সত্যি তা চিন্তিত করার মত। তিনি জানালেন, কেন্দ্র সচিব বা তার প্রেরিত প্রতিনিধি প্রশ্নপত্র গ্রহণ করে থাকেন। কেন্দ্রে এনে পরীক্ষা শুরু’র ৩০ মিনিট আগে প্যাকেট খুলে রুমে রুমে পাঠানো হয়। এসময় তার কাছে প্রশ্ন ছিল, ট্রেজারী থেকে প্রশ্নপত্র আনার সময় কী কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়? অথবা যিনি বা যারা প্রশ্নগুলি নিয়ে আসেন তাদের উপর কোন নজরদারী থাকে কিনা। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, নিরাপত্তা বলতে প্রশ্ন গ্রহণকারীর সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং সর্বোপরি সীলগালা অবস্থাটি নিশ্চিত করা। সীলগালা’র বিষয়টি জানতে চাইলে জানানো হয়, কর্তৃপক্ষের সীল দিয়ে সীলগালা করা থাকে যা কোন সময় নজরদারীতে রাখা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কেউ গালা’র উপর পয়সা এমনকি লোহার নাটের কিছু দিয়ে চাপ দিয়ে সীল গালার কাজটি সম্পন্ন করে থাকে। অর্থাৎ কেউ যদি সীলগালা তালা খুলে আবার সীলগালা করে তা ধরার পথ থাকে না।
পরীক্ষা কেন্দ্রের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িত একজন প্রবীন শিক্ষক জানালেন, মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করায় এবং মোবাইলের ফেস বুকে থাকার অপরাধে অনেক পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার এমনকি গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মচারী এমনকি পিওনের কাছে মোবাইল থাকার বিষয়টি কতটুকু যুক্তিযুক্ত। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে ৩০ মিনিট আগে প্রশ্ন পত্রের প্যাকেট খুলে রুম অনুযায়ী গণনা করা হয়। এসময় যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা কাক্সিক্ষত নাম্বার, ফেসবুক বা মেইলে পাঠিয়ে দেয় তাহলে এর দায় কে নেবে। পরীক্ষা শুরুর আগে সকলের ব্যস্ততার মধ্যে একজন দুষ্টজনের জন্য এ কাজটি করা অত্যন্ত সহজ বলেই এই শিক্ষক মনে করে থাকেন।
এছাড়া পরীক্ষা শুরুর আগে দায়িত্বের কারণে কেন্দ্রের সচিবকে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। শুধু তাই নয় পরীক্ষা শুরু’র আগে বোর্ড কর্মকর্তা, শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা, ভিজিল্যান্স টিমের সদস্য, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির কর্তাসহ মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর মত কেউ না কেউ উপস্থিত থাকে। এদের কেউ যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ছবি আকারে নেয়ার কাজটি করে থাকেন তাহলে বেচারা শিক্ষকের কী করার থাকে?
এসব নিছক দায় এড়ানোর কথা হলেও মনে হতে পারে। তবে একেবারে ফেলে দেয়ার বিষয়ও নয়। বিজি প্রেস থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশ্নপত্র পৌঁছানোর উপরের বিবরণের মধ্যেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য লুকিয়ে আছে।



 

Show all comments
  • Md sk ২০ অক্টোবর, ২০১৯, ৮:৫৩ এএম says : 0
    প্রশ্নের ফাঁস চাই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ