Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা গতিশীলতা বৃদ্ধিতে অপরিহার্য অটোমেশন এখনো অপরিপূর্ণ

| প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : সকল খাত-উপখাতে ডিজিটালাইজেশনের বিষয়ে প্রতিনিয়তই তাগিদ দেয়া হচ্ছে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল থেকে। অথচ ডিজিটালাইজেশন সঠিক সময়ে সঠিকভাবে এগুচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। দেশের আমদানি-রফতানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ-শিল্পায়ন, রাজস্ব আহরণের প্রধান দ্বার চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। আর সেখানেই হোঁচট খাচ্ছে ডিজিটালাইজেশন ব্যবস্থা। ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে এগিয়ে চলা দেশের প্রধান এই বন্দরের দক্ষতা, সক্ষমতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য দিকটি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় অটোমেশন ব্যবস্থা। এই অটোমেশন পদ্ধতি অনে আগেই চালু করা হলেও এখন পর্যন্ত তা অপূর্ণাঙ্গ বা অপরিপূর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে। বন্দরের দৈনন্দিন কার্যক্রমের আংশিক চলছে অটোমেশনে। অনেক কিছুই এখনও চালানো হচ্ছে ম্যানুয়াল বা পুরনো ব্যবস্থাপনায়। এতে করে প্রত্যাশিত গতি ও দক্ষতা মিলছে না। অবসান হয়নি হয়রানি ও জটিলতার। বন্দর ব্যবহারকারীরা (স্টেক হোল্ডারগণ) পাচ্ছেন না যুগোপযোগী সেবা। তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) সূত্র জানায়, বন্দরের আগাগোড়া কার্যক্রমকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। ধাপে ধাপে সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে।
প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে শত শত কোটি টাকার আমদানি-রফতানিমুখী নিত্যপণ্য, ভোগ্য ও সেবাজাত পণ্যসামগ্রী ও শিল্পের কাঁচামাল হ্যান্ডলিং করা হয়। জাহাজবহর হ্যান্ডলিংয়ের কাজসহ সমগ্র পণ্য হ্যান্ডলিং, মজুদ ও পরিবহন কর্মকাÐে দৈনিক কোটি কোটি টাকা অপচয় রোধ করে ব্যয় সাশ্রয় এবং সময়ের অপচয়রোধের টার্গেট রেখে সাড়ে ৫ বছর পূর্বে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে ‘কন্টেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিটিএমএস)’ অটোমেশন তথা ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা চালু হয়। পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় জাহাজবহর ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অর্থাৎ সিটিএমএস পদ্ধতি এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এই অটোমেশন পদ্ধতি বাস্তবায়নের পর থেকেই নানামুখী সমস্যা ও জটিলতার মধ্যদিয়ে তা এগিয়ে চলেছে। তাছাড়া সিটিএমএস অটোমেশন বা পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পদ্ধতি সফল ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের পর্যাপ্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের অভাব রয়েছে। রয়েছে নিজেদের মাঝে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় কোন কোন ক্ষেত্রে অনীহা এবং অনভিজ্ঞতা। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অভ্যস্ত রয়ে গেছে তাদের অনেকেই।
চট্টগ্রাম বন্দরে মোট হ্যান্ডলিং করা আমদানি-রফতানিমুখী পণ্যের ৬০ ভাগই হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পখাত। এই খাতের শিল্প মালিক ও রফতানিকারকরা এখনও পুরোপুরি সিটিএমএস’র আওতায় বন্দর কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম হয়ে ওঠেনি। তবে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য গ্যাস, বিদ্যুতের চলমান সংকট এবং সড়ক, রেল ও নৌ-পরিবহনে সীমাবদ্ধতাসহ বহুমাত্রিক সমস্যা রয়ে গেছে। বন্দরে রয়েছে স্থানাভাব (জেটি-বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড ও শেড) এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ঘাটতি। এসব কারণে সময়মতো রফতানি চালান বন্দরে পৌঁছানো ও শিপমেন্ট নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে করে সাড়ে ৫ বছর পরও স্বয়ংক্রিয় সিটিএমএস অটোমেশনের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনার কাজ অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরকে সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে এমনটি মনে করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।
দেশের সমগ্র আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ ভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আদা-রসুন, ফল-মূল, কৃষিবীজ থেকে শুরু করে মৌলিক শিল্প-কারখানার যন্ত্রপাতি (ক্যাপিাটাল মেশিনারিজ) পর্যন্ত দৈনিক শত শত কোটি টাকা মূল্যের শতাধিক রকমের পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারের সার্ভিস চার্জ ও রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরে বিগত ২০১৭ সালে আমদানি-রফতানিমুখী কন্টেইনার ওঠানামায় অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় ২৫ লাখ ৬৩ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এর আগের বছরে (২০১৬ সাল) হ্যান্ডলিং করা হয় ২৩ লাখ ৪৬ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার, বিগত ২০১৫ সালে ২০ লাখ ২৪ হাজার, ২০১৪ সালে ১৭ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার। এমনিভাবে বছর বছর পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২০১৫ সালে ১৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৬ শতাংশ ও ২০১৭ সালে তা প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। খোলা সাধারণ মালামাল (ব্রেক বাল্ক কার্গো) হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মেট্রিক টন। প্রধান এই সমুদ্র বন্দরে সূচকের সকল ক্ষেত্রে পণ্যসামগ্রী বৃদ্ধির চাপ ও চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু মৌলিক, ভৌত অবকাঠামো সুবিধা, সক্ষমতা ও দক্ষতা সেই তুলনায় সমানুপাতে হারে বাড়ছে না। পিছিয়ে পড়ছে। জেটি-বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড শেড এবং যান্ত্রিক সরঞ্জামের অপ্রতুলতার কারণে বন্দরের সেবার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীর গতিতে। ডিজিটালাইজেশন বা অটোমেশন হোঁচট খেয়ে চলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজবহর বিশেষ করে কন্টেইনার ফিডার জাহাজের নিয়মিত আসা-যাওয়া, কন্টেইনারের অবস্থান, জাহাজেবাহিত পণ্যসামগ্রীর বিবরণ, বিল দাখিল ও পরিশোধ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল অটোমেশন পদ্ধতির আওতায় ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিগত ২০১১ সালের নভেম্বর মাস সিটিএমএস-এর বহু প্রতীক্ষিত কার্যক্রম শুরু হয় প্রাথমিক পরিসরে। এ ব্যবস্থাপনা প্রচলনের কারণে বন্দরের বহুল আলোচিত ‘টেবিলে টেবিলে ২০ থেকে ২৪টি স্বাক্ষরে’র ঝক্কি-ঝামেলার অবসান হবে এমনটি ছিল প্রত্যাশা। তবে গোড়াতেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও সমন্বয়ের অভাবে রফতানিমুখী তৈরিপোশাক শিল্পখাত সিটিএমএস-এ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বন্দর ব্যবহারকারী অন্যান্য ট্রেড বডি ও প্রতিষ্ঠান সিটিএমএস’র আওতায় আসে, তবে অনেকেই সীমিতভাবে। যা এখনও পরিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করেনি।
সিটিএমএস পদ্ধতি চালুর আগে বন্দর ব্যবহারকারীদের মনোনীত প্রতিনিধিদের ধারাবাহিকভাবে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সিটিএমএস’র স্বয়ংক্রিয় অটোমেশন ব্যবস্থাপনায় বন্দর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, দক্ষতা, গতি ও সেবার মান উন্নত করা এবং সময় ও আর্থিক অপচয় অনেকাংশে হ্রাসের টার্গেট ছিল। এর ফলে বন্দরের ধারণক্ষমতা ৫০ ভাগ বৃদ্ধিসহ বন্দর সক্ষমতা বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় পোর্ট-শিপিং, কাস্টমস সার্কেলে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩শ’ বন্দরে সিটিএমএস পদ্ধতি প্রচলিত আছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে সিটিএমএস পদ্ধতি চালু হলেও এর আওতায় জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। এর কারণ অপারেটরদের ন্যূনতম দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। গার্মেন্টস খাতে রয়েছে নানামুখী সমস্যা, সীমাবদ্ধতা। বন্দর-শিপিং সার্কেলে জানা গেছে, সিটিএমএস অটোমেশন পদ্ধতি পুরোদমে কার্যকর করা সম্ভব হলে বন্দরে জাহাজ থেকে কন্টেইনার লোডিং, আনলোডিং, ইয়ার্ডে কন্টেইনার স্থানান্তর, ট্র্যাকিং, ডেলিভারি পরিবহন, গেট কন্ট্রোলসহ সকল বন্দর কার্যক্রম অনলাইনে বা অটোমেশনে সম্পন্ন করা যাবে। সকল চার্জ ফি মাশুল ডিউজ পরিশোধ, তথ্য-উপাত্তসহ বন্দর অপারেশনাল কার্যক্রম অনলাইন নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। এরফলে আমদানি-রফতানি সহায়ক হয়ে উঠবে স্বয়ংক্রিয় সিটিএমএস পদ্ধতি। দেশী-বিদেশী আইটি ও পোর্ট-অটোমেশন বিশেষজ্ঞরা সিটিএমএস’র কারিগরি বিন্যাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর প্রায়োগিক দিক, কার্যকারিতা ও অগ্রগতি আগেই তদারক করে আসছেন। তারা সফলতার ব্যাপারে আশাবাদী।
চট্টগ্রাম বন্দর সিটিএমএস স্বয়ংক্রিয় অটোমেশন কার্যক্রমে কারিগরি প্রযুক্তি বিন্যাস করেছে সিঙ্গাপুর, উত্তর আমেরিকা-ভিত্তিক এবং দেশীয় খ্যাতনামা আইটি ও বন্দর-অটোমেশন বিশেষজ্ঞদল ও কারিগরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে সিটিএমএস প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। সিটিএমএস অপারেশন পরবর্তী আরও ৫ বছর প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালন কাজে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এসটি ইলেকট্রনিক্স, নেভিস এবং কানাডীয় ও দেশীয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি সরবরাহকারী নামিদামি আইটি, বন্দর-অটোমেশনে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে এ প্রকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ চালিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে ২০১১ সালের মার্চে নির্বাচিত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তথ্য-প্রযুক্তি ভাÐারের নিরাপত্তা, কারিগরি বিপর্যয় এবং হ্যাকিং রোধের সম্ভাব্য সকল উপায় গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয় সিটিএমএস প্রযুক্তি বিন্যাসের ক্ষেত্রে।
কন্টেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন পদ্ধতির (সিটিএমএস) আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরের ১১টি কন্টেইনার জেটি-বার্থ পরিচালিত হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), সিসিটি এবং জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)। বেসরকারি কন্টেইনার ইয়ার্ডগুলোকে (আইসিডি) অটোমেশনের সাথে সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। সিটিএমএস ব্যবস্থাপনায় কোনো নির্দিষ্ট জাহাজের বার্থিং (ভিড়া) সিডিউল মিলছে অনলাইনে। অটোমেশনে বন্দর কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে তার ধারণা সহকারে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় শিপিং সিএন্ডএফ পরিবহন এজেন্ট, মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও), ফিডার বার্থ অপারেটর, অফডক, যান্ত্রিক সরঞ্জাম অপারেটর ও মালিক সংগঠন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, শিল্পমালিক, কনসাইনি, আমদানি-রফতানিকারক প্রতিনিধিদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যানুয়াল বা সেকেলে ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন অটোমেশন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে সময় লাগবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ