Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খালেদা জিয়ার পেছনে নেতাকর্মীদের ঢল ফিরোজাতে স্বজনদের আবেগঘন পরিবেশ

| প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন : ভোর ৪টা থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা, সমাবেশ, জমায়েত নিষিদ্ধ করেছিল পুলিশ। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি।
ঢাকার প্রতিটি সড়কেই একটু পর পর পুলিশ-র‌্যাবের গাড়ির টহল। রাস্তায় নেই নিত্য দিনের যানজট, কোলাহল। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। এরই মধ্যে কোন কোন সড়কে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নিয়ে শোডাউন দিচ্ছে আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গোটা দেশ তখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। রায় হবে দলের প্রধানের কিন্তু রাস্তায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বিএনপির নেতাকর্মীদের। মনে করা হচ্ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হয়তো কেউই খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে আসতে পারবেন না। সবাইকে অবাক করে দেয় বেলা ১১টা ৪২ মিনিটে গুলশান থেকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার পরপরই। এতো কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থার মধ্যেই ধীরে ধীরে নেতাকর্মীরা যুক্ত হতে থাকেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে। কোনো বাধাই আটকাতে পারেনি বিএনপির নেতাকর্মীদের। দলের চেয়ারপারসন ও তাদের প্রিয় নেত্রীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। গাড়ির বহর সামনের দিকে এগুতে এগুতে যেন ঢল নামে আদালতের পথে। লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে গতকাল বকশীবাজারের অস্থায়ী আদালতে যান খালেদা জিয়া।
এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় শুনতে গতকাল (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টা ৪২ মিনিটে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা হন তিনি। কিন্তু পথে পথে পুলিশ আর র‌্যাবের বাঁধা ও সরকারি দলের লোকজনের সাথে সংঘর্ষের মধ্যদিয়েই বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে যোগ দিতে শুরু করেন বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী। তাদের গগণবিদারী ¯েøাগানগুলোর মধ্যে ছিল- ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দি হতে দেবনা’। ‘জেল দিবি আমায় দে, দেশনেত্রীকে খালাস দে’।
এদিকে রায় শুনতে আদালতের উদ্দেশে বের হওয়ার আগে খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজায় দলের কয়েকজন নেতাকর্মী এবং তার স্বজনদের উপস্থিতিতে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বেগম জিয়ার বড় বোন, ভাই, ভাবী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রিয় নেত্রী আদালতে যাওয়ার আগে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে খালেদা জিয়া শুধু বলেছেন- আপনারা কেউ দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইবেন।
স্বত:স্ফূর্ত গণজমায়েত: বেলা পৌনে ১২ টায় বেগম জিয়া গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। তার গাড়িবহর গুলশান-১ হয়ে পুলিশ প্লাজা, হাতিরঝিল লিঙ্ক রোড হয়ে নাবিস্কো মোড়ে পৌঁছলে চারদিক থেকে আস্তে আস্তে গাড়িবহরে যোগ দিতে শুরু করেন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীরা। এভাবে গাড়িবহর তিব্বত, সাত রাস্তার মোড় দিয়ে এফডিসির মোড়ে পৌঁছলে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। শুরু হয় নেতাকর্মীদের স্বত:স্ফূর্ত গণজমায়েত। ফলে বেগম জিয়ার গাড়িবহরের গতি কিছুটা থমকে যায়। একপর্যায়ে মগবজার ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে গাড়িবহর ধীর গতিতে এগিয়ে যায় রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মগবাজারে। সাধারণত তিনি ফ্লাইওভার দিয়ে আদালতে যেতেন। বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে গাড়িবহর মগবাজার পৌঁছলে দলের অসংখ্য নেতাকর্মী তার গাড়িবহরে যোগ দেন। একে একে ছুটে আসেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ও সাবেক এবং বর্তমান ছাত্রনেতারা। নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আবেগাপ্লুত হয়ে অনেক সাধারণ মানুষও খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে যোগ দেন। এসময় অন্যদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, শিরিন সুলতানা, আমিনুল হক, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, মুহাম্মদ আবদুল আউয়াল, শহিদুল ইসলাম বাবুল, হারুনুর রশিদ, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, শফিউল বারী বাবু, সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, আবু নাসের মো: রহমাতুল্লাহ, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, হেলেন জেরিন খান, এলডিপির নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম, ঢাকা মহানগর বিএনপির কাজী আবুল বাশার, তানভীর আহম্মেদ রবিন, ছাত্রদলের রাজীব আহসান, মামুনুর রশিদ মামুন, আলমগীর হাসান সোহান, নাজমুল হাসান, ইখতিয়ার রহমান কবির, মফিজুর রহমান আশিক, কাজী মোক্তার হোসেন, মিনহাজুল ইসলাম ভুইয়া, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারি, নাহিদুল ইসলাম সুহাদ, ঢাবি ছাত্রদলের আল মেহেদী তালুকদার, আবুল বাশার, শাহীন, হাফিজুর রহমান, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান, শিবচর বিএনপি নেতা জহের গোমস্তা, শহীদুল ইসলাম দিপু, শহীদুল্লাহ বেপারী, বেলায়েত হোসেন, সালাম শেখ, আজমুল হুদা চৌধুরী ইথুসহ অনেকে। বিএনপি ছাড়াও ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদল, মহিলা দল, শ্রমিক দল, ঢাকা মহানগরীর নেতাকর্মীরা গাড়িবহরে অংশ নেন।
একপর্যায়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহর মগবাজার অতিক্রম করে কাকরাইল অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। পথে পথে সরকারী দলের লোকজন বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে উস্কানিমূলক ¯েøাগান দিলে বিএনপির নেতাকর্মীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছুঁড়ে। তবে পুলিশ উভয়পক্ষকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। এভাবেই কাকরাইল মোড়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে বেলা ১টা ৮মিনিটে গাড়িবহর পৌঁছলে বিএনপি নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছুঁড়ে। কিছুক্ষণের জন্য বেগম জিয়ার বহর থেমে যায়। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। এরপরও পুলিশী বাধা অতিক্রম করে নেতাকর্মীরা তাদের প্রিয় নেত্রী বেগম জিয়ার গাড়িবহর থেকে চলে যায়নি। তারা নেত্রীর নামে বিভিন্ন ¯েøাগান দিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার গাড়িবহর মৎস্যভবন, প্রেসক্লাব সংলগ্ন কদম ফোঁয়ারা, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্ত¡র, চাঁনখারপুল অতিক্রম করে বকশিবাজারের বিশেষ আদালতের দিকে অগ্রসর হয়। তবে হাইকোর্ট মোড়ে নেতাকর্মীদের দিকে চড়াও হয় র‌্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবির সদস্যরা। কিন্তু আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনীর বাধায় চাঁনখারপুলের পর নেতাকর্মীরা আর সামনে যেতে পারেনি। এসময় সেখানে অন্তত ২০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ ও ডিবি পুলিশ আটক করে বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর কদম ফোয়ারা অতিক্রম করার পর পৃথক গাড়িতে থাকা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে তারা হেটে বিশেষ আদালতে যান।
উৎসুক জনতা: এদিকে বেগম জিয়ার গাড়ি বহরকে ঘিরে উৎসুক মানুষের মনে দেখা দেয় কৌতুহল। সড়কের উভয় পাশে বিভিন্ন অফিস ও আবাসিক ভবনে থাকা লোকজন জানালা খুলে বেগম জিয়ার গাড়ি বহরের দৃশ্য অবলোকন করেন। রাস্তায়ও নেমে আসেন সাধারণ মানুষ। অনেকে মোবাইলে বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ভিডিও করেন এবং ছবি তুলেন। কেউ কেউ বিএনপি নেতাকর্মীদের স্বত:স্ফূর্ত গণজমায়েতকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দেন এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়িবহরের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশ সদস্য। গাড়ির সামনে ছিল পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি এবং পেছনে ছিল র‌্যাবের মোটরসাইকেলের বহর। এদিন সড়ক বন্ধ রেখে নির্বিঘেœ আদালতে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। এছাড়া খালেদা জিয়ার গাড়িবহর যে সড়ক ব্যবহার করে আদালতে পৌঁছায় সেসব সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে র‌্যাব পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি চোখে পড়ে।
বাসভবনে আবেগঘন পরিবেশ: ওদিকে খালেদা জিয়া আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার আগে গুলশানে তার বাসভবন ‘ফিরোজা’য় বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং তার স্বজনদের উপস্থিতিতে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, মহিলা দল নেত্রী সুলতানা আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান, শামসুদ্দিন দিদার, বেগম জিয়ার বড় বোন সেলিনা হোসেন ও ভগ্নিপতি, ভাই শামীম এস্কান্দার, ভাবী ও ছেলে, আরেক ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী ও ছেলে, খালেদা জিয়ার বোনের ছেলেসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা। বেগম জিয়া উপস্থিত সবার সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেন। তিনি বলেছেন, কেউ দুশ্চিন্তা করবেননা। আমার জন্য দেশবাসীসহ সবার কাছে দোয়া চাইবেন। সবাই ধৈর্য ধারণ করবেন। এরআগে লন্ডনে অবস্থানরত বড় ছেলে তারেক রহমান, তার স্ত্রী ও মেয়ে এবং ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী এবং মেয়ের সাথে কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। পরে বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানসহ গাড়ি বহর নিয়ে বেলা ১১ টা ৪২ মিনিটে রাজধানীর বকশিবাজারে অবস্থিত আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা হন খালেদা জিয়া।



 

Show all comments
  • আরাফাত ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৪:২৪ এএম says : 0
    বিএনপিকে আরো সংঘবদ্ধ হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ