Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারপ্রাপ্ত এমডির অনিয়মে ডুবছে পিডিবিএফ

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রতিবাদ করলেই শোকজ ও চাকরি হারাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা : ৪/৫ মাস বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় সোলার কর্মীদের মানবেতর জীবন-যাপন
পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহার লাগামহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। তার অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির এখন নাজুক অবস্থা। জুলাই ২০১৭ থেকে নভেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫কোটি টাকা। এসব অনিয়মের প্রতিবাদও করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বললেই শোকজ ও চাকরি হারানোর হুমকি দিচ্ছেন মদন মোহন সাহা। একই সঙ্গে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়োগ বাণিজ্য। এদিকে দীর্ঘ এক যুগ প্রকল্পে চাকরি করলেও চাকরি স্থায়ী না হওয়া এবং মদন মোহন সাহার অত্যাচারে বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির ৩শ’ সোলার কর্মী। এসব কর্মীরা মাত্র ৩৩শ’ থেকে ৬ হাজার টাকা বেতন স্কেলে চাকরি করছেন। যা কর্মীদের পরিবার নিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এদিকে প্রতিদিনই চাকরি হারানোর সঙ্কায় আছেন এসব কর্মীরা। গত ১ বছরেই সোলার কর্মী ৩৯৮ থেকে কমে ২৮৫ জনে দাড়িয়েছে। এক বছরে বিভিন্ন ভাবে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে প্রায় ১শ’ জন কর্মীকে। গড়ে প্রতিটি উপজেলায় ৪/৫ মাসের বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। কর্মীদের মাঠ পর্যায়ের কাজের ক্ষেত্রে কোনরূপ সহযোগীতা না থাকায় এবং প্রশাসনের নেতিবাচক মনোভাব, বেতন বৈষম্য, চাকুরীর অনিশ্চয়তায় কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর ফলে মাঠ পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং মাঠপর্যায়ে আদায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যার দায় দেয়া হচ্ছে প্রকল্পের কর্মীদের উপর। এসব অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় তাকে সহায়তা করছেন প্রতিষ্ঠানটির সৌর শক্তি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহিদ হোসেন সেলিম।
পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে একটি স্ব-স্বাশীত নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যা ১৯৯৯ সালে সংবিধানের ২৩ নং আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দারিদ্র্য বিমোচনের মহান ব্রত নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই আজ দারিদ্র্যে পীড়িত।
সূত্র মতে, মদন মোহন সাহা এবং সৌর শক্তি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহিদ হোসেন সেলিমের লাগামহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় অসহায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ দু’জনের যোগসাজশে টিআর ও কাবিখা কর্মসূচীর আওতায় সোলার স্থাপন করে ৫শতাংশে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাত করেন। টিআর কাবিখায় ৫টি উপজেলায় কাজ হয় ৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। এই টাকার মধ্য থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকা কমিশনের নামে আত্মসাত করেন মদনমোহন সাহা, সহিদ হোসেন সেলিম, ডুমুরিয়া উপজেলা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা উজ্জল কুমার ভট্টাচার্য্য এবং ডুমুরিয়া উপজেলার হিসাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন। এই অনিয়মের সকল কাগজ-পত্রাদি ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালকের যোগসাজসে ঘোড়াঘাট উপজেলার টিআর কাবিখার চেক গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা না করে ঘোড়াঘাট উপজেলা সোলার কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলামের ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টে সরকারী টাকা জমা করেন। হরিপুর উপজেলার টিআর কাবিখার চেক সোলার কর্মকর্তা মিরাজুল ইসলামের ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টে এই দু’জনের নির্দেশে জমা করা হয়। পরবর্তীতে দুটি এ্যাকাউন্ট থেকে ২০শতাংশ টাকা আত্মসাত করে বাকী টাকা সৌর শক্তি প্রকল্পের এ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। এদিকে এই দুই কর্মকর্তা সু-কৌশলে খোলা বাজার থেকে ইডকলের অনুমোদন বিহিন নিম্নমানের এ্যাডভ্যান্স সোলার প্যানেল ক্রয় এবং ষ্টোরের পুরাতন মাল টিআর কাবিখায় সরবরাহ করে বড় অংকের কমিশন গ্রহণ করেন। যা সরকারের ভাবমূর্তিতে আঘাত হেনেছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অপরদিকে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৯ তম বৈঠকে কমিটির সভাপতি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর পিডিবিএফ’র অডিট রিপোর্টের আপত্তি মন্তব্যের সঙ্গে স্থায়ী কমিটি একমত পোষণ করে। এক্ষেত্রে মন্তব্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া এবং ১ মাসের মধ্যে মহা-হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে জানানোর কথা থাকলেও যা দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া
ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মদনমোহন সাহা ও সৌরশক্তি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহিদ হোসেন সেলিমের নিয়োগ অবৈধ বলে ৩০ এপ্রিল ২০০০ সাল থেকে ৩০ জুন ২০০৪ পর্যন্ত সময়ের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাই এই অবৈধ নিয়োগের কাগজপত্র তদন্ত করে দেখার জন্য গত বছরের ৩ মে একটি আবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সচিবকে প্রেরণ করা হয়।
এখানেই শেষ নয়; মদন মোহন সাহা প্রতিষ্ঠানের মামলা খরচের নামে প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হিসেবে আত্মসাত করেছেন। পাশাপাশি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানের দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চাকরী থেকে অব্যহতি এবং পরবর্তীতে তিনি ছুটিতে থাকা অবস্থায় রাতের আধারে এই দুই কর্মকর্তাকে অর্থের বিনিময়ে চাকরীতে পুনঃবহাল করেন। অথচ পিডিবিএফ’র সোলার প্রকল্পের কর্মীদের অন্যায়ভাবে চাকরীচ্যুত করা হলেও তারা বড় অংকের টাকা সরবরাহ করতে না পারায় তাদেরকে পুনঃবহালও করা হয়নি। এদিকে পিডিবিএফ সম্প্রসারণ প্রকল্পে লোক নিয়োগের অপেক্ষমান তালিকার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৩৮ জন মাঠ সংগঠককে নিয়োগ দেন সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচলক মনারুল ইসলামের সহযোগিতায়। যেখানে সোলার প্রকল্পের কর্মীরা অনাহারে অর্ধাহারে জীবন-যাপন করছে সেখানে তিনি লোক নিয়োগ দিয়ে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন। এদিকে মদন মোহন সাহা গাড়ী ব্যবহারেও ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। একাই ৩টি গাড়ী ব্যবহার করছেন। নিজে একটি স্ত্রী ও সন্তান ২টি গাড়ী ব্যবহার করছেন। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে মদন মোহন সাহা একাই ৪টি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন। এগুলো হল-ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক অর্থ পরিচালক মানব সম্পদ এবং অতিরিক্ত পরিচালক মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা। আর এ কারণে অতিসহজে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটিতে এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র কায়েম করছেন। একই সঙ্গে জনবল নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা স্বত্তেও নিজ ক্ষমতাবলে নিয়োগ, বদলী ও পদায়ন করছেন মদন মোহান সাহা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মদন মোহন সাহা ইনকিলাবকে বলেন, অনিয়মের সুযোগ নেই, কারণ নিয়মিত অডিট হচ্ছে। একই সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই। তাহলে ৩৮ জনকে কিভাবে নিয়োগ দেয়া হল জানতে চাইলেও তিনি একই কথা জানান।
এছাড়া খেলাপী ঋণের বিষয়ে বলেন, মাঠে এক হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপী ঋণ আছে। এটা প্রতিবছরই হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ