ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মাদকের ভয়ংকর থাবা যুবসমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করা হচ্ছে। এর পরও অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই; বরং অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সরকারের মন্ত্রী, আমলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি- সবাই একযোগে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় কথা বলছেন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের এ বক্তব্য ও আহ্বান সংবাদপত্রগুলোতে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হচ্ছে। বলাবাহুল্য, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের হুমকির বাইরে নেই আমাদের দেশও। বিশ্বের তাবৎ দেশ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের হুমকির মধ্যে আছে। আমাদের দেশে ইতিপূর্বে বেশ কিছু জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এতে অনেকে নিহত ও আহত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, তা মোকাবিলায় আহ্বান জানানো কিংবা অভিযান, ধর-পাকড় চালানো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হুমকি যে সর্বনাশা মাদক, তা নিয়ে সরকারি মহলে খুব একটা কথা শোনা যায় না। মাদক সন্ত্রাস মোকাবিলায় এগিয়ে আসার সে রকম জোরালো আহ্বান জানানো হয় না। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান-আটক তো হয় না বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কেন এই অমনোযোগ, অবহেলা এর কোনো সদুত্তর নেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রায়ই এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করেন যে, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বহু জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনে অভিযান অব্যাহত আছে এবং এর উৎসাদন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাদের এসব কথাবার্তায় আমরা আশ্বস্তবোধ করতে পারি। তবে আমরা অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন ও বিস্তার নিয়ে। কিছুদিন আগে সরকারের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জঙ্গিবাদের চেয়ে মাদক আরও ভয়ঙ্কর। তার এ কথার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই।
জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তি বা পরিবার। সমাজে ভীতি-শঙ্কাও বাড়ে। কিন্তু মাদক ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে রীতিমত বিপর্যস্ত ও ধ্বংস করে দিচ্ছে। জাতিবিনাশী সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন ও বিস্তার সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করছে। সমাজের এমন কোনো শ্রেণি বা স্তর নেই যেখানে মাদক ঘাঁটি গেড়ে না বসেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম, হাট-বাজার, ওষুধের দোকান, মুদি দোকান ও টং দোকান পর্যন্ত সর্বত্র মাদকের ছড়াছড়ি। কর্ম, পেশা, বয়স নির্বিশেষে মানুষ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণরাই বেশি সংখ্যায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। শহরের বিত্তবানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়–য়া সন্তান থেকে গ্রামের হতদরিদ্রের বেকার-বখাটে সন্তান পর্যন্ত মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত।
কে না জানেন, আমাদের শিশু-কিশোর-তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। একদিন তারাই দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেবে। অথচ, আজ মাদক আগ্রাসনে তারাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক ও উদ্বেগজনক আর কিছু হতে পারে না। মাদকের কারণে সমাজে খুন, ধর্ষণ, অনিরাপত্তা, বিশৃঙ্খলা ও নানা ধরনের অপরাধের বিস্তার ঘটছে। মাদকের কারণে শহর-গ্রাম সর্বত্রই খুনোখুনি, পারিবারিক অশান্তি, বিচ্ছেদ-বিপর্যয় যে কত ঘটছে, তার কোনো সীমা-সংখ্যা নেই। মাদকের জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে মাদকাসক্তরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যে করছে না। প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এর মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেয়া এ তথ্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কতটা বিপর্যস্ত ও নাজুক হয়ে পড়েছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, মাদকাসক্তদের সংখ্যা বিশেষত, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আরো অনেক বেশিই হবে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বংশধররা সবার চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
জাতিবিনাশী মাদকের সহজলভ্যতা মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির একমাত্র কারণ। রাজধানী থেকে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম, যেখানেই হাত বাড়ানো যায়, সেখানেই কোনো না কোনো মাদক পাওয়া যায়। আমাদের সীমান্তের ওপারে ভারত ও মিয়ানমার (বার্মা) থেকে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বানের পানির মতো দেশে ঢুকছে। সুনিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারী চক্র ও তাদের এদেশীয় প্রভাবশালী এজেন্ট, গডফাদাররা সবকিছু ম্যানেজ করে মাদক সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে ডিলারদের হাতে। ডিলাররা পৌঁছে দিচ্ছে আসক্তদের হাতে হাতে। জাতিবিনাশী মাদকের অবাধ অনুপ্রবেশ, চলাচল কেনাবেচা ও সেবন রোধ করা ছাড়া এর দৌরাত্ম্য ও আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভের সহজ কোনো পথ নেই। অবাধে মাদকের রাস্তা খোলা রেখে যদি বলা হয়, কেউ মাদক সেবন করবে না, আদৌ সেটা কাজে আসবে কী? অতএব, মাদক চোরাচালান ডেড স্টপ করতে হবে, চোরাচালানী চক্রের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে হবে এবং যত প্রভাবশালীই হোক না কেন এর মূল হোতাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ গুরু দায়িত্ব নিতে হবে সীমান্তে বিজিবি ও সাগরে কোস্টগার্ড এবং দেশের অভ্যন্তরে পুলিশ-র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনীকে। সীমান্ত ও সাগর পথে মাদক আসতে না পারলে এবং দেশের অভ্যন্তরে মাদকের চলাচল, কেনাবেচা বন্ধ করতে পারলেই তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর মাদকের বিরুদ্ধে, মাদক কারবারী তথা মাদক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালাতে পারলেই কেবল মাদক নির্মূল সহজ হয়ে যাবে।
নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কী, দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন মাদকব্যবসার সাথে জড়িত। তারা বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। সত্যি বলতে কী দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। মাদকের রয়েছে বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে। রাজধানীতেও মাদকব্যবসা রমরমা।
মাদকের জগতে এক সময় ‘হেরোইন’ নামক মরণ নেশা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। এ পদার্থটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি খুব দামি বলে পরবর্তী সময়ে এর স্থান দখল করে নেয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বর্তমান নেশাসক্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ দুটি নেশাদ্রব্য বেশি জনপ্রিয়। একে ঘিরে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। ফেনসিডিলের চেয়ে ইয়াবাই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ সমাজের প্রতি। বেকারত্বও মাদকের বিস্তারে সহায়ক- এমন কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা। এই মরণ নেশার বিস্তারে সমাজে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটি সমাজের অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে-মধ্যে ছোটখাট মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। যারা ইতোমধ্যেই মাদকাসক্ত হয়েছে তাদেরও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়াতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যাও। সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে।
লেখক: সদস্য নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), সিনিয়র সহ-সভাপতি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও সভাপতি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ পরিষদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।