ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
শ্যামল রায় : একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে রপ্তানি আয়ের ভূমিকা অপরিসীম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। খাতটির আয় দেশের সমগ্রিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সংগতকারণেই তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা সার্বিক দিক থেকেই উদ্বেগজনক। সম্প্রতি পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, একক দেশে হিসেবে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের সর্ববৃহৎ বাজার যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। সেই দেশ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগেও মোট পোশাক রপ্তানি আয়ের এক-চতুর্থাংশ আসত।
কিন্তু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ ও ঘরে-বাইরে দুষ্টচক্রের নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে মার্কিন সরকারের সাথে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই দেশটিতে বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাকখাতে আসতে থাকে ধারাবাহিক ধস।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর আমদানি হওয়া তৈরি পোশাকের ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ যোগান দিয়েছিল বাংলাদেশ, চলতি বছর প্রথম সাত মাসে সেটি কমে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষনীয়, বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি সামনে এলেও এ সময়ে ভিয়তনাম ও ভারতের বাজারে হিস্যা বেড়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক পোশাক আমদানি গত বছরের চেয়ে কিছুটা কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিতে যে ধস নেমেছে তা আমলে নেওয়া এখন একান্ত জরুরি। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কালো থাবা ও বায়িং হাউসগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা বা পক্ষপাতিত্বও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
রানা প্লাজা ধসের পর গার্মেন্ট শিল্প ও শ্রমিকদের কল্যাণ বিবেচনায় বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সকে ডেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কল্যাণ তো দূরের কথা উল্টো খাল কেটে কুমির আনা হয়েছে। এটা সত্য কিছু অসাধু শিল্প মালিকের অতি মুনাফা লাভের কারণে রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটে। তবে শিল্পটির বেশিরভাগ মালিকের সৎ বিবেচনা ও শ্রমিক কল্যাণে মনোযোগের কারণে কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে দেশে আনা হয়। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, নানা সমস্যায় জর্জরিত গার্মেন্ট শিল্পের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে পড়েছে সংগঠন দু’টি। জানা যায়, প্রয়োজন না থাকা স্বত্তে¡ও সংস্কারের নামে গার্মেন্ট মালিকদের ওপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিচ্ছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স। শুধু তা-ই নয়, নির্দিষ্ট দেশ-কোম্পানি থেকে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি উচ্চ বেতনে নিজেদের প্রকৌশলীদের তত্ত¡বধানে কাজ করানোর শর্ত দেয়া হচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে গার্মেন্ট মালিকরা নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। ব্যাংক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কেউ কেউ ঘুরছে দ্বারে দ্বারে আবার মামলার ভয়ে আত্মসম্মান রক্ষায় কেউ বা ভিটেবাড়ি, জমি-জমা সহায় সম্বল বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে।
এভাবে খবরদারি করে মালিকেদের লাখ লাখ টাকা খরচ করানোর পরও খোঁড়া অজুহাতে চুক্তি বাতিল করে ক্রতা সরিয়ে নিতে, নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স। ফলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও আশপাশের এলাকার ১ হাজার ২৩১টি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে তাদেরও প্রত্যাশিত দামের কমে পোশাক সরবরাহ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন জোটের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তাদের হস্তক্ষেপ উদ্দেশ্যমূলক, হয়রানিমূলক ও ব্যয়বহুল। গার্মেন্ট মালিকরা যেন আয় পকেটে তুলে সক্ষমতা অর্জনের পরিবর্তে কারখানাতে বিনিয়োগেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন, এমন একটা যড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কর্মকান্ডে। তাছাড়া ঘরের শত্রু বায়িং হাউজগুলো বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ নিচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে এসব বায়িং হাউজ তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় আটকে দিচ্ছে। এমন কি চুক্তি অনুযায়ী মূল্য পরিশোধেও ঝামেলা বাঁধাচ্ছে। বায়িং হাউজগুলোর এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকান্ডের অভিযোগ গেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সম্প্রতি এক চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বস্ত্র খাতে বাণিজ্যবিরোধে বায়িং হাউজগুলো সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। এরা মূলত ক্রেতার পক্ষে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে রপ্তানি সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার ফলে প্রাপ্য পরিশোধ না করাসহ চুক্তিমূল্য থেকে ছাড় দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব সমস্যা একদিকে যেমন রপ্তানিকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে পণ্য রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। জানা গেছে, বায়িং হাউজ নিয়ন্ত্রণে দেশে সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই। এছাড়া বায়িং হাউজগুলোকে বিজিএমইএ এর সদস্য পদ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হলেও ‘সদস্য হতেই হবে’ এরকম কোন বাধ্যকতা নেই। এই সুযোগে তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। এসব বায়িং হাউজ পরিচালনায় কোন নীতিমালা নেই। ফলে চুক্তি ভঙ্গ করে পে-মেন্ট আটকে দেওয়া, প্রতিশ্রæত অর্থ না দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বায়িং হাউজের রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে সংশ্লিষ্ট বিধি সংশোধন করায় ট্রেড লাইসেন্স ও টি আইএন-ভ্যাট সনদ বাদে আর কোন সুনির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন পড়ে না। ব্যবসার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ অথবা সিটি করেপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া এখন অনক সহজ। ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর পর ভ্যাট সনদ গ্রহণের সুযোগ থাকায় ভ্যাট সনদ ছাড়াই বায়িং হাউজগুলোর ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ থেকে যায়। ফলে, ধরাকে সরা মনে করে তারা খেয়াল খুশিমত কর্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা গার্মেন্ট শিল্পের উপর।
একটি কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, গার্মেন্ট শিল্পে দেশি-বিদেশি যড়যন্ত্র নতুন নয়। তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানি লক্ষমাত্রা ৫০ মিলিয়ন ডলার করার পর ষড়যন্ত্র আরো বিস্তৃতি হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বায়িং হাউজগুলো ও অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে এরই মধ্যে অনেক বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য বাজারে চলে গেছে। সকলকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের পোশাক শিল্প মালিক শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠেছে, কারো দয়া বা কৃপায় নয়। তাই কোন স্বার্থন্বেষী মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের কাছে মাথা নোয়ানোর অবকাশ নেই। সংস্কারের নামে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কোন অন্যায় আবদার মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলে এদেরকে অবশ্যই এ দেশ থেকে বিদায় নিতে হবে। তা না হলে সম্ভাবনাময় এ শিল্প খুব অল্প সময়েই পৌঁছে যাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির উপর। সামগ্রিক বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে দুষ্টুচক্রের রাহুগ্রাস থেকে গার্মেন্ট শিল্পকে বাঁচানো তথা অর্থনীতির অস্তিত্ব রক্ষা করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও ব্যবসায়ী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।