Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত

ক্ষুদ্র ঋণের অবাধ দৌরাত্ম্য

| প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী পুঁজিতে রূপান্তরিত
সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : ক্ষুদ্র ঋণের অবাধ দৌরাত্ম্য নরসিংদীসহ দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপযর্য় ডেকে এনেছে। সৃষ্টি করেছে হাজার হাজার মধ্যস্বত্বভোগী। তৈরী হয়েছে অসংখ্য অনুমোদিত বাজার। ছিন্ন করেছে উৎপাদক-ভোক্তার সম্পর্ক। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার একচেটিয়া দখল করে নিয়েছে। আড়তদার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের যোগসাজসে এসব মধ্যস্বত্বভোগী মনোপলি ব্যবসা করছে। সর্বনাশ ঘটাচ্ছে সাধারণ মানুষের।
ঋণ বিতরণের পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং সুদ সমেত ঋণ আদায়ের কঠিন শর্ত নরসিংদীসহ সারাদেশে এই নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী পূঁজিতে রুপান্তরিত হয়ে চাল, ডাল, নুন, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করছে। স্বাধীনতাত্তোর কালে দেশের শিল্প পূঁজি ব্যবসায়ী পূঁজিতে পরিণত হয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে হানা দিয়েছিল। প্রত্যহিক দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি করে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল। জিনিসপত্র মজুদ করে দেশে কৃত্রিম দূর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল, ডেকে এনেছিল রাজনৈতিক বিপর্যয়। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী পুঁজিতে পরিনত হয়েছে। এসব ব্যবসায়ী পূঁজি দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করে নরসিংদীসহ দেশের বাজার অস্থিতিশীল করে রাখছে। চাল, ডাল, নুন, তেল, শাকসব্জীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত উর্দ্ধমূল্য সচেতন মানুষকে শংকিত করে তুলেছে। চালের দাম আশানুরুপ কমছে না, কমছেনা পিঁয়াজসহ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের মূল্যও। এক বছরেই চালের দাম বেড়েছে ৭ বার। আমন ও আউশ ধান কাটার মৌসুমেই দাম বেড়েছে ৪ বার। বর্তমান আমন মৌসুমে ফলন ভাল হয়েছে প্রচার করা হলেও এর প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না। কয়েকবার মূল্য বেড়ে এখন চালের দাম থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, নরসিংদীসহ দেশের হাট-বাজারে চাল-ডাল, নুন, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণের অবাধ দৌরাত্ম্য। সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে দেয়া কোটি কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাবে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অননুমোদিত বাজার। আর এসব অননুমোদিত অসংখ্য বাজারই জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, নরসিংদীতে শতাধিক এনজিও ও লগ্নি প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, পপি, পিদিম, আহসানিয়া মিশন, ঠেংগাসহ বিভিন্ন এনজিও হাজার হাজার সমিতির মাধ্যমে এসব ক্ষুদ্র পূঁজি সরবরাহ করেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে নরসিংদী জেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের ৭৫ হাজার গ্রাহকের নিকট ২২১ কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণ রয়েছে। আশা’র ১ লাখ ২৪ হাজার গ্রাহকের নিকট ৩১৩ কোটি টাকা, ব্র্যাকের ৬০ সহ¯্রাধিক গ্রাহকের নিকট রয়েছে ২৬০ কোটি টাকা ঋণ। এমনিভাবে কমবেশী অর্ধশতাধিক এনজিও ও লগ্নি প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এছাড়া নরসিংদীতে রয়েছে কমবেশী শতাধিক সমবায়ী লগ্নিকারি। আর এসব প্রতিষ্ঠানের রয়েছে চড়া সুদে কোটি কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ। সুদের টাকা ভোগ করছে লগ্নি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এসব সুদের দায়ভার পরছে সাধারণ গরীব মানুষের ঘাড়ে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র এবং লগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোও ২০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ বিতরণ করেছে। যেসব ঋণ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন যাত্রা উন্নয়নের জন্য এসব ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হলেও এখন তা সকল শ্রেণীপেশার মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহিতারা জানিয়েছেন, তাদের ক্ষুদ্রঋণ তাদের জন্যও গলার কাঁটা। ঋণ নিয়ে শান্তিতে নেই ঋণ গ্রহীতারা। এনজিওদের দেয়া কোনো ক্ষুদ্র ঋণই উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করা যায় না। ঋণ গ্রহণ করার এক মাসের মাথায়ই সুদ সমেত কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়। কিস্তি পরিশোধের জন্য আবার আরেক এনজিও কিংবা ব্যক্তি পর্যায় থেকে ঋণ নিতে হয়। দেশে এমন কোন শস্য নেই যা এক মাসে উৎপাদিত হয়। কোন উৎপাদনেই এই ঋণ কাজে আসে না। যার ফলে সুদের টাকা যোগাড় করার জন্য ক্ষুদ্র ঋণগুলো এক শ্রেণীর মধ্যসত্ত¡ভোগী ব্যবসায়ীদের পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যসত্ত¡ভোগীরা এসব ক্ষুদ্র ঋণগুলোকে ব্যবসায়ী পূঁজিতে পরিণত করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের বাজারে বিনিয়োগ করে। চাল, ডাল, নুন, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, জিরাসহ বিভিন্ন শাকসব্জীর ব্যবসায় বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লুটে নিচ্ছে। এই ক্ষুদ্রঋণের দৌরাত্ম্যের কারণে উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণীর মধ্যে সরাসরি পন্যে বিনিময় হওয়ার কথা। সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা কৃষকদের নিকট থেকে তাদের উৎপাদিত ফসল ও শাকসব্জী ক্রয় করে তারা মধ্যস্বত্ত¡ নিয়ে সেই পন্য সরবরাহ করছে আড়তে বা পাইকারী ক্রেতাদের কাছে। পাইকারী ক্রেতারা এসব পন্য পূনরায় বিক্রি করছে পাইকারী আড়তে। আড়তদাররা পূনরায় বিক্রি করছে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়াদের কাছে। ফড়িয়ারা এসব মালামাল আড়ত বা ময়াল থেকে কিনে তাদের চাটাইয়ে বসে চড়া দামে বিক্রি করছে। নরসিংদীসহ দেশের পুর্ব ও উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র বাজার। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যায় এসব বাজার থাকে ফড়িয়াদের দখলে। এসব বাজারে উৎপাদকরা কোন উৎপাদিত পন্য নিয়ে আসে না। বাজারগুলোকে যত খুচরা বিক্রেতা রয়েছে, তার ৯৯ ভাগই হচ্ছে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়া। নরসিংদী শহরে সকাল, বৈকালিক ও সন্ধ্যা সব সময়ই কোনো না কোন কাঁচাবাজার চালু থাকে। সকালের বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় মাছ, শাকসব্জী, ইত্যাদি আমদানী হলে বৈকালিক ও সন্ধ্যা বাজারের ফড়িয়ারা সকালের বাজার থেকে পাইকারী হারে মাছ ও শাকসব্জী কিনে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত তারা এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় মাছ, শাকসব্জী, ইত্যাদি বিক্রি করে। যেখানে সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাজার গড়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী চড়া দামে বিক্রি করার সুযোগ পায়। প্রবীনজনেরা জানিয়েছেন, সুদূর অতীতকাল থেকে দেশের বড় বড় বাজারগুলোতে শেষ বেচাকেনা হতো ‘হরেদরে’। বাজার শেষ হয়ে আসলে অর্থাৎ বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেলে উৎপাদকরা তাদের পন্য হরেদরে অর্থাৎ না লাভ, না লোকশান দরে বিক্রি করে দিতো। এতে শেষ বাজারে গরীব ক্রেতা সাধারণ কমদামে জিনিসপত্র কিনে খেতে পারতো। এখন আর সে অবস্থা নেই। যেখানে সেখানে বাজার গড়ে ওঠায় মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়ারা এক বাজার থেকে আরেক বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করার সুযোগ পায়। যা পূর্বের সাপ্তাহিক বাজারগুলোতে ছিল না।
নরসিংদী জেলার মনোহরদীতে চালাকচরের বিখ্যাত বাজার জমতো শুক্রবার ও সোমবার। বিকেল থেকে রাত ১ টা পর্যন্ত এ বাজারে বেঁচাকেনা চলতো। চালাকচর বাজার থেকে বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ সাপ্তাহিক বাজার করতো। এ বাজারে বেশীরভাগ উৎপাদিত পন্য নিয়ে আসতো চাষী। দীর্ঘ ৭/৮ ঘন্টা বেঁচাকেনার পর বাড়তি থেকে যাওয়া মালামাল বিক্রি করতো হরেদরে। কারণ এ বাজার ভেঙ্গে যাবার পর সপ্তাহকালব্যাপী এলাকায় কোন বাজার জমতো না। এখন চালাকচর বাজারটি মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের দখলে চলে গেছে। এ বাজারে এখন উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। শত শত মহিলা ও পুরুষ সমিতি এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তারা সেই ক্ষুদ্র ঋণ বিনিয়োগ করছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে। তারা তাদের ক্ষুদ্র পূঁজি ব্যবসায়ী পূঁজিতে পরিনত করে কৃষকের জমি থেকে অগ্রীম দিয়ে উৎপাদিত পণ্য কিনে নিচ্ছে। পরে তারা এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করছে তাদের ইচ্ছেমত চড়া দামে।
সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : ক্ষুদ্র ঋণের অবাধ দৌরাত্ম্য নরসিংদীসহ দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপযর্য় ডেকে এনেছে। সৃষ্টি করেছে হাজার হাজার মধ্যস্বত্বভোগী। তৈরী হয়েছে অসংখ্য অনুমোদিত বাজার। ছিন্ন করেছে উৎপাদক-ভোক্তার সম্পর্ক। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার একচেটিয়া দখল করে নিয়েছে। আড়তদার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের যোগসাজসে এসব মধ্যস্বত্বভোগী মনোপলি ব্যবসা করছে। সর্বনাশ ঘটাচ্ছে সাধারণ মানুষের।
ঋণ বিতরণের পদ্ধতিগত ত্রæটি এবং সুদ সমেত ঋণ আদায়ের কঠিন শর্ত নরসিংদীসহ সারাদেশে এই নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী পূঁজিতে রুপান্তরিত হয়ে চাল, ডাল, নুন, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করছে। স্বাধীনতাত্তোর কালে দেশের শিল্প পূঁজি ব্যবসায়ী পূঁজিতে পরিণত হয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে হানা দিয়েছিল। প্রত্যহিক দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি করে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল। জিনিসপত্র মজুদ করে দেশে কৃত্রিম দূর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল, ডেকে এনেছিল রাজনৈতিক বিপর্যয়। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী পুঁজিতে পরিনত হয়েছে। এসব ব্যবসায়ী পূঁজি দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করে নরসিংদীসহ দেশের বাজার অস্থিতিশীল করে রাখছে। চাল, ডাল, নুন, তেল, শাকসব্জীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত উর্দ্ধমূল্য সচেতন মানুষকে শংকিত করে তুলেছে। চালের দাম আশানুরুপ কমছে না, কমছেনা পিঁয়াজসহ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের মূল্যও। এক বছরেই চালের দাম বেড়েছে ৭ বার। আমন ও আউশ ধান কাটার মৌসুমেই দাম বেড়েছে ৪ বার। বর্তমান আমন মৌসুমে ফলন ভাল হয়েছে প্রচার করা হলেও এর প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না। কয়েকবার মূল্য বেড়ে এখন চালের দাম থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, নরসিংদীসহ দেশের হাট-বাজারে চাল-ডাল, নুন, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণের অবাধ দৌরাত্ম্য। সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে দেয়া কোটি কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাবে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অননুমোদিত বাজার। আর এসব অননুমোদিত অসংখ্য বাজারই জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, নরসিংদীতে শতাধিক এনজিও ও লগ্নি প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, পপি, পিদিম, আহসানিয়া মিশন, ঠেংগাসহ বিভিন্ন এনজিও হাজার হাজার সমিতির মাধ্যমে এসব ক্ষুদ্র পূঁজি সরবরাহ করেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে নরসিংদী জেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের ৭৫ হাজার গ্রাহকের নিকট ২২১ কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণ রয়েছে। আশা’র ১ লাখ ২৪ হাজার গ্রাহকের নিকট ৩১৩ কোটি টাকা, ব্র্যাকের ৬০ সহ¯্রাধিক গ্রাহকের নিকট রয়েছে ২৬০ কোটি টাকা ঋণ। এমনিভাবে কমবেশী অর্ধশতাধিক এনজিও ও লগ্নি প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এছাড়া নরসিংদীতে রয়েছে কমবেশী শতাধিক সমবায়ী লগ্নিকারি। আর এসব প্রতিষ্ঠানের রয়েছে চড়া সুদে কোটি কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ। সুদের টাকা ভোগ করছে লগ্নি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এসব সুদের দায়ভার পরছে সাধারণ গরীব মানুষের ঘাড়ে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র এবং লগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোও ২০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ বিতরণ করেছে। যেসব ঋণ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন যাত্রা উন্নয়নের জন্য এসব ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হলেও এখন তা সকল শ্রেণীপেশার মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহিতারা জানিয়েছেন, তাদের ক্ষুদ্রঋণ তাদের জন্যও গলার কাঁটা। ঋণ নিয়ে শান্তিতে নেই ঋণ গ্রহীতারা। এনজিওদের দেয়া কোনো ক্ষুদ্র ঋণই উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করা যায় না। ঋণ গ্রহণ করার এক মাসের মাথায়ই সুদ সমেত কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়। কিস্তি পরিশোধের জন্য আবার আরেক এনজিও কিংবা ব্যক্তি পর্যায় থেকে ঋণ নিতে হয়। দেশে এমন কোন শস্য নেই যা এক মাসে উৎপাদিত হয়। কোন উৎপাদনেই এই ঋণ কাজে আসে না। যার ফলে সুদের টাকা যোগাড় করার জন্য ক্ষুদ্র ঋণগুলো এক শ্রেণীর মধ্যসত্ত¡ভোগী ব্যবসায়ীদের পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যসত্ত¡ভোগীরা এসব ক্ষুদ্র ঋণগুলোকে ব্যবসায়ী পূঁজিতে পরিণত করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের বাজারে বিনিয়োগ করে। চাল, ডাল, নুন, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, জিরাসহ বিভিন্ন শাকসব্জীর ব্যবসায় বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লুটে নিচ্ছে। এই ক্ষুদ্রঋণের দৌরাত্ম্যের কারণে উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণীর মধ্যে সরাসরি পন্যে বিনিময় হওয়ার কথা। সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা কৃষকদের নিকট থেকে তাদের উৎপাদিত ফসল ও শাকসব্জী ক্রয় করে তারা মধ্যস্বত্ত¡ নিয়ে সেই পন্য সরবরাহ করছে আড়তে বা পাইকারী ক্রেতাদের কাছে। পাইকারী ক্রেতারা এসব পন্য পূনরায় বিক্রি করছে পাইকারী আড়তে। আড়তদাররা পূনরায় বিক্রি করছে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়াদের কাছে। ফড়িয়ারা এসব মালামাল আড়ত বা ময়াল থেকে কিনে তাদের চাটাইয়ে বসে চড়া দামে বিক্রি করছে। নরসিংদীসহ দেশের পুর্ব ও উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র বাজার। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যায় এসব বাজার থাকে ফড়িয়াদের দখলে। এসব বাজারে উৎপাদকরা কোন উৎপাদিত পন্য নিয়ে আসে না। বাজারগুলোকে যত খুচরা বিক্রেতা রয়েছে, তার ৯৯ ভাগই হচ্ছে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়া। নরসিংদী শহরে সকাল, বৈকালিক ও সন্ধ্যা সব সময়ই কোনো না কোন কাঁচাবাজার চালু থাকে। সকালের বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় মাছ, শাকসব্জী, ইত্যাদি আমদানী হলে বৈকালিক ও সন্ধ্যা বাজারের ফড়িয়ারা সকালের বাজার থেকে পাইকারী হারে মাছ ও শাকসব্জী কিনে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত তারা এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় মাছ, শাকসব্জী, ইত্যাদি বিক্রি করে। যেখানে সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাজার গড়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী চড়া দামে বিক্রি করার সুযোগ পায়। প্রবীনজনেরা জানিয়েছেন, সুদূর অতীতকাল থেকে দেশের বড় বড় বাজারগুলোতে শেষ বেচাকেনা হতো ‘হরেদরে’। বাজার শেষ হয়ে আসলে অর্থাৎ বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেলে উৎপাদকরা তাদের পন্য হরেদরে অর্থাৎ না লাভ, না লোকশান দরে বিক্রি করে দিতো। এতে শেষ বাজারে গরীব ক্রেতা সাধারণ কমদামে জিনিসপত্র কিনে খেতে পারতো। এখন আর সে অবস্থা নেই। যেখানে সেখানে বাজার গড়ে ওঠায় মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়ারা এক বাজার থেকে আরেক বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করার সুযোগ পায়। যা পূর্বের সাপ্তাহিক বাজারগুলোতে ছিল না।
নরসিংদী জেলার মনোহরদীতে চালাকচরের বিখ্যাত বাজার জমতো শুক্রবার ও সোমবার। বিকেল থেকে রাত ১ টা পর্যন্ত এ বাজারে বেঁচাকেনা চলতো। চালাকচর বাজার থেকে বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ সাপ্তাহিক বাজার করতো। এ বাজারে বেশীরভাগ উৎপাদিত পন্য নিয়ে আসতো চাষী। দীর্ঘ ৭/৮ ঘন্টা বেঁচাকেনার পর বাড়তি থেকে যাওয়া মালামাল বিক্রি করতো হরেদরে। কারণ এ বাজার ভেঙ্গে যাবার পর সপ্তাহকালব্যাপী এলাকায় কোন বাজার জমতো না। এখন চালাকচর বাজারটি মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের দখলে চলে গেছে। এ বাজারে এখন উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। শত শত মহিলা ও পুরুষ সমিতি এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তারা সেই ক্ষুদ্র ঋণ বিনিয়োগ করছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে। তারা তাদের ক্ষুদ্র পূঁজি ব্যবসায়ী পূঁজিতে পরিনত করে কৃষকের জমি থেকে অগ্রীম দিয়ে উৎপাদিত পণ্য কিনে নিচ্ছে। পরে তারা এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করছে তাদের ইচ্ছেমত চড়া দামে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ