ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
গত ১৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় একটা খবর এসেছে তার আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে উপস্থাপিত এক গবেষণা প্রবন্ধের বরাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, আমেনা মহসিন ও দেলোয়ার হুসেনের করা ঐ গবেষণায় নাকি পাওয়া গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উগ্রবাদ প্রকট হচ্ছে দিনদিন। উদ্বেগজনক খবর নিঃসন্দেহে। তাই পুরো খবর পড়তে লাগলাম। সদ্য প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট বা অনলাইনে আর কোথাও না পাওয়া গেলেও পত্রিকা থেকে জানা গেছে, গবেষকদের চোখে উগ্রবাদের আলামত হচ্ছে সম্ভাষণ, বিদায়সহ দৈনন্দিন নানা কাজে আরবি শব্দের ব্যবহার, মেয়েদের হিজাব, নেকাব পরিধান, ছেলেদের গোড়ালির উপর প্যান্ট পরিধান ইত্যাদি। এগুলো নাকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত কোন গবেষণা প্রবন্ধে এর আগে এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে কি না জানি না, তবে তথাকথিত প্রগতিশীল বুুদ্ধিজীবীদের পত্রিকায় লেখা বিভিন্ন কলামে এর আগেও এ ধরনের উদ্বেগ দেখা গেছে। অনেক দিন আগে জনৈক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এক পত্রিকায় লিখোছিলেন, আগে বিদায় সম্ভাষণ জানানো হতো ‘খোদা হাফেজ’ বলে, এখন সেখানে ‘আল্লাহ হাফেয’ বলা হয়। আগে রোযা বলা হতো, ইদানীং অনেকেই রমযান বা রামাদ্বান বলছেন। ঐ বুদ্ধিজীবীর মতে এসব নাকি মৌলবাদের কালো ছায়া।
এসকল বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধির বহর দেখলে মনে হয়, আসলেই বাংলাদেশে উগ্রবাদ প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ মূলধারার বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত অধ্যাপক ও কলাম লেখকরা যদি ভাষা কিংবা পোশাকের মধ্যে উগ্রবাদ খোঁজেন, তাহলে ধরে নিতে হয়, এসকল বুদ্ধিজীবী ঐ ভাষা কিংবা পোশাকের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী চিন্তা লালন করেন। আর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের সাথে সম্পর্কিত কোন ভাষা কিংবা পোশাকের বিরুদ্ধে যদি সেই দেশের বুদ্ধিজীবীরা উগ্র চিন্তা লালন করেন, তবে সে দেশে উগ্রবাদ যে প্রকট আকার ধারণ করেছে, তাতে আর সন্দেহের কি আছে!
এসকল বুদ্ধিজীবীর চিন্তার দৈন্য ইতোপূর্বেও বেশ হাসির খোরাক যুগিয়েছে। মনে পড়ছে কয়েক বছর আগের কথা। তখন মিসরে হুসনি মোবারকের পতনের পর মুরসিরও পতন হয়েছে, সেনাশাসক সিসি সদ্য ক্ষমতা দখল করেছেন। এদেশের এক নামজাদা বুদ্ধিজীবী প্রথমসারির এক জাতীয় দৈনিকে এতে স্বস্তি প্রকাশ করে লিখলেন, হুসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তিনি নাকি ভেবেছিলেন, এরা প্রাগ্রসর চিন্তা চেতনার অধিকারী। কিন্তু ইখওয়ানের উত্থানে তিনি আশাহত হয়েছেন। সেই তুলনায় সেনাশাসক সিসিই অনেক ভালো, অন্তত মৌলবাদি তো নয়! অর্থাৎ, ঐ মাননীয় বুদ্ধিজীবী মোবারক বিরোধীদের পোশাক দেখেই তাদের চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে ধারণা করে বসেছিলেন, ফলে পরে আশাহত হতে হয়েছে।
আমি মুরসি কিংবা সিসির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্যে উদাহরণটি উপস্থাপন করিনি, শুধু আমাদের এসকল বুদ্ধিজীবীর চিন্তার জগতের হাল-হকিকত বোঝাতে উদাহরণটি উল্লেখ করলাম। এরা কাউকে নামাজ পড়তে দেখলে ভাবেন, লোকটা বোধ হয় মৌলবাদি-উগ্রবাদি, গোড়ালির উপরে প্যান্ট পরতে দেখলে ভয় পেয়ে যান, বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম শুনলে নিশ্চিত হয়ে পড়েন এই লোকটা মৌলবাদি না হয়ে যায় না! বোরকা-নেকাব, দাঁড়ি-পাঞ্জাবি তো আরো ভয়ংকর! অথচ একটু তলিয়ে দেখতে চান না, তাঁরা নিজেরা কতটা প্রান্তিক চিন্তা-চেতনা লালন করেন।
এদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, কাজেই ইসলামী পরিভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ জনপ্রিয় হবে, এটাই স্বাভাবিক। ছেলেদের গোড়ালির উপর কাপড় পরার নির্দেশ ইসলামে আছে, অতএব ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এটা পালন করুন কিংবা না করুন, আরেক মুসলমানকে পালন করতে দেখলে বিষয়টা বাঁকা চোখে দেখার কথা না। আবার একজন অমুসলিমের চোখে বিষয়টা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, এমনকি অযৌক্তিকও ভাবতে পারেন, তাই বলে যে মুসলমান তার ধর্মের নির্দেশ পালনার্থে এভাবে প্যান্ট পরবে, তাঁকে কটাক্ষ করতে পারেন না। ব্যক্তিগতভাবে কিংবা নিজ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করার স্বাধীনতা তাঁর থাকলেও যে ব্যক্তি তার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে প্রয়োজনীয় মনে করছে, তাকে বিদ্রæপ করার স্বাধীনতা তো তাঁর নেই। কেননা তাহলে যে ঐ ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয়, যা কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই কথা বোরকা-নেকাব-হিজাব, পাঞ্জাবি-পাজামা, টুপি-দাঁড়ি এসবের ক্ষেত্রেও। আপনি ব্যক্তিগতভাবে কিংবা আপনার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসবকে অপ্রয়োজনীয় মনে করতে পারেন, কিন্তু আরেকজনকে এ বিষয়ে কটাক্ষ করতে পারেন না, করলে আপনি একজন উগ্রবাদী হিসেবেই প্রতীয়মান হবেন। অন্যের সংস্কৃতি মেনে নেওয়ার মতো উদারতা না থাকাটাই আপনার প্রকট উগ্রবাদের পরিচয় বহন করবে।
অনুরূপভাবে বলা যায়, এদেশের মানুষ হাজার বছর ধরে ইসলামী সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। ফলে ইসলামী অনেক পরিভাষা এদেশের ভাষার নিজস্ব শব্দে পরিণত হয়েছে। এসকল শব্দ এদেশের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে গেছে। এখন কেউ যদি এগুলোর বিরোধিতা করেন, তবে সেটা তাঁর গোড়ামির পরিচয় বহন করবে, কোন মতেই এসকল শব্দ ব্যবহারকারীর গোড়ামির পরিচয় বহন করবে না। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনের ফলে এদেশে অনেক ইংরেজি শব্দও চালু হয়েছে। এখন আপনি যদি এসকল ইংরেজি শব্দ মেনে নিতে পারেন, তাহলে তারও শত শত বছর আগে এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে যাওয়া আরবি-ফার্সি শব্দ মানতে আপনার অসুবিধা কী?
আবার শত বছরের ইংরেজ শাসনের পরও বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করেনি, এমন অনেক ইংরেজি শব্দ গত এক-দুই দশকে বাংলায় নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করে বসেছে, ঠিক তেমনি হাজার বছরেও বাংলায় প্রচলিত হয়নি, এমন অনেক আরবি শব্দও গত এক-দুই দশকে বাংলা ভাষায় বহুলরূপে প্রচলিত হয়েছে। মূলত বিশ্বায়নের ফলেই এরকমটি হয়েছে। একসময় এদেশের মানুষ ফার্সি ‘রোযা’ কিংবা বড়জোর ফার্সি প্রভাবিত আরবি ‘রমজান’ শব্দের সাথে পরিচিত থাকলেও বিশ্বায়ন আর তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে এখন দেখতে পাচ্ছে সারা দুনিয়ায় এই অর্থে ‘রামাদ্বান’ বা এরকম কাছাকাছি উচ্চারণের একটি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে অনেকেই এখন এই শব্দটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে, ঠিক একইভাবে অনেক ইংরেজি শব্দও আজকাল বহুল প্রচলিত হচ্ছে বাংলায়। এই স্বাভাবিক বিষয়টিকে যদি কোন বুদ্ধিজীবী কিংবা অধ্যাপক উগ্রবাদ বলে ধারণা করেন, তবে তাঁদের বুদ্ধির বহর নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হবে, সঙ্গত কারণেই। (ভাষাতাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, সেটা ভিন্ন কথা।)
মজার বিষয় হলো, এই গবেষণা প্রবন্ধেই যে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে, তন্মধ্যে একটি হলো ‘আরবি ধর্মীয় বইগুলো প্রচুর বাংলা অনুবাদ করতে হবে, যাতে মানুষ ধর্মের বিষয়গুলো নিজের ভাষায় জানতে ও বুঝতে পারে।’ ইসলামের নাম ব্যবহার করে যেসকল উগ্রবাদ ছড়ানো হয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে এই সুপারিশটি অত্যন্ত কার্যকর, সন্দেহ নেই। এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। একসময় বাংলা একাডেমি প্রচুর ধর্মীয় বই অনুবাদ করলেও এখন প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের কার্যক্রম থেকে সরে এসেছে। ইসলামি ফাউন্ডেশনে এখনো এ ধরনের কার্যক্রম মোটামোটি চালু আছে। কিন্তু গবেষকদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, আরবি শব্দের ব্যবহারই যদি হয় উগ্রবাদের অন্যতম নিদর্শন, তাহলে কিন্তু তাঁদের এই সুপরিশটি বুমেরাং হতে পারে! কারণ আরবি বইয়ের অনুবাদ যত বৃদ্ধি পাবে, এদেশে আরবী চর্চা ততো জনপ্রিয় হবে। ফলে আরবি শব্দের ব্যবহার তথা (গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী) উগ্রবাদও আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পেতে পারে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের চিন্তার জগতের বাতিঘর হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। সেখান থেকে জাতি দিক-নির্দেশনা আশা করবে, এটাই স্বাভাবিক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শুধু উগ্রবাদই নয়, বরং যে কোন জাতীয় সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে, এমনটা আশা করা নিশ্চয় অন্যায় নয়। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নিকট থেকে এ ধরনের হাস্যকর গবেষণা প্রবন্ধ কোনভাবেই কাম্য নয়। তাঁদের নিকট থেকে আরো গভীর চিন্তামূলক গবেষণাই সবাই কামনা করে। আশা করি, জাতীয় পর্যায়ের এসকল বুদ্ধিজীবী ভবিষ্যতে আরো দায়িত্বশীলতার সাথে গবেষণা করবেন, আরো দিক-নির্দেশনামূলক গবেষণাকর্ম প্রকাশ করবেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।