Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অরক্ষিত রেলক্রসিং নিয়ে উদাসীন রেলওয়ে

ধূমকেতুর চালকের দক্ষতায় রক্ষা পেল ৭ প্রাণ

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : সকাল সাড়ে ১০টা। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ধুমকেতু এক্সপ্রেস ছুটছে রাজশাহীর দিকে। টাঙ্গাইল থেকে ছেড়ে ট্রেনটি যখন মহেড়া সেকশনের মাঝামাঝি, তখনই চালক দেখলেন সামনে অরক্ষিত একটি রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি সিএনজি অটোরিকশা। কয়েকবার হর্ণ বাজানোর পরেও অটোরিকশাটি না সরায় ট্রেন চালক বুঝতে পারেন এটি স্টার্ট বন্ধ হয়ে আটকে গেছে। সাথে সাথে ইমারজেন্সী ব্রেক কষে ট্রেন থামিয়ে দিলেন ট্রেন চালক (লোকোমাস্টার) আসাদুজ্জামান আসাদ। থামতে গিয়েও ট্রেনের ইঞ্জিন সামান্য ধাক্কা মারে সিএনজি অটোরিকশাকে। তবে প্রাণে বেঁচে গেছে অটোরিকশায় থাকা ৭দিন বয়সের শিশু, তার মা ও অটোরিকশার চালকসহ ৬ জন। আশপাশের লোকজন ছুটে এসে পরে সিএনজি অটোরিকশাকে রেললাইন থেকে সরিয়ে দেয়। একই সাথে তারা দক্ষতার সাথে ট্রেনটি থামানোর জন্য ট্রেনের চালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সারাদেশে অরক্ষিত রেলগেটে প্রতিনিয়ত এরকম দুর্ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানী ঘটে। মাঝে মধ্যে ট্রেন চালকের দক্ষতায় ও আল্লাহর অশেষ রহমতে রক্ষা পায় প্রাণ। কিছুদিন আগেও টাঙ্গাইলের কাছেই এক রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ট্রেনের সহকারী চালক নিহত হয়েছেন। ট্রেন চালকরা জানান, ঘন কুয়াশায় অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কুয়াশার কারনে রাতে ২৫ গজ সামনেও ঠিকমতো দেখা যায় না। অন্ধকারে হাতিয়ে চলার মতো ট্রেন চালাতে হয়। এমতবস্থায় যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় থাকতে হয় চালকদের। নিরাপত্তাহীনতার এই ঝুঁকি যাত্রীদের জন্যও কম নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদেশে রেল নেটওয়ার্কে মোট ২ হাজার ৫৪১টি লেবেল ক্রসিং আছে। যার মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা মাত্র ৭৮০টি। বাকি ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রক্ষী বা গেউটকিপার আছে। ৫৩৮টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ে রক্ষী বা গেউটকিপার নেই। অর্থাৎ আনম্যান হিসোবে রয়েছে মোট ২ হাজার ২৯৯টি লেবেল ক্রসিং। এতে করে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ক্ষতি হচ্ছে রেল তথা দেশের সম্পদের।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেনকে মানুষ এখনও নিরাপদ ভ্রমনের জন্য উপযুক্ত মনে করে। অথচ ট্রেনের নিরাপদে চলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ। এই রেলপথকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য লেবেল ক্রসিংগুলোকে সুরক্ষিত করা জরুরী। পরিসংখ্যান বলছে, গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ের প্রতি খুব একটা নজর নেই রেল কর্তৃপক্ষের। বরং প্রতিনিয়ত সারাদেশেই অবৈধ লেবেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোন স্থানে নতুন রেললাইন নির্মাণ করলে প্রয়োজনে লেবেল ক্রসিং নির্মাণ করে সেখানে রক্ষী বা গেউটকিপার নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু রেলকে না জানিয়ে বা অনুমোদন না নিয়ে এলহিজইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রেল লাইনের উপর লেবেল ক্রসিং নির্মাণ করে থাকে। যা রেলওয়ের আইনে নিষিদ্ধ। এক সময় এই প্রবণতা এতোটাই বেশি ছিল যে রেল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব ক্রসিংয়েই এখন প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানি ঘটছে। সূত্র জানায়, অবৈধ ও অরক্ষিত লেবেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে। যেগুলো এখন বিচারাধীন আছে। কোনো কোনা মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কারনে মাঝপথে ঝুলে আছে। জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেবেল ক্রসিংয়ের ২৩টিরই কোনো অনুমোদন নেই। এ কারনে ট্রেনগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে না। আলাপকালে কয়েকজন চালক বলেন, ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়ার পরে ট্রেনের গতি বাড়াতেই ভয় লাগে। না জানি কোথাও লেবেল ক্রসিংয়ের উপর গাড়ির সারি রয়েছে এই ভয় কাজ করে মনে। সে কারনে আসলে নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানো যায় না। আবার নির্ধারিত গতিতে ট্রেন না চালালে কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। জানা গেছে, অরক্ষিত লেবেল ক্রসিংয়ের সাথে সরক্ষিত লেবেল ক্রসিংগুলোতেও রক্ষী বা গেইটকিপাররা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। স্থায়ী চাকরিজীবী না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারে না রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত তিন বছরে সারাদেশে লেবেল ক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৯শ’টি। বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে অকার্যকর সিগন্যাল ব্যবস্থা, লেবেল ক্রসিংয়ের অব্যবস্থা এবং চালকের সিগন্যাল অমান্য করাকে দায়ী করা হয়েছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, গেইটম্যান লেবেল ক্রসিংয়ের গেইট বন্ধ না করার কারণে রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ বাধে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক যাত্রী হতাহত হন। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন। এসব দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে লেবেলক্রসিংগুলোকে সুরক্ষিত করতেই হবে। একই সাথ্যে অবৈধ লেবেল ক্রসিংগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। ##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ