Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পাহাড়ের মানুষ

পাহাড়জুড়ে ভীতিকর অবস্থা

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১৫ খুন-গুমসহ বছরে অর্ধশত অপহরণ
সৈয়দ মাহাবুব আহামেদ, রাঙ্গামাটি থেকে : পাহাড় আর দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ। তাতেই অনিন্দ্য সুন্দরের এক বিশাল ক্যানভাস যেন তিন পার্বত্য জেলা। তবে, এমন মোহনীয় সৌন্দর্য আর সম্ভাবনার আড়ালে পাহাড় এখন যেন এক আতঙ্কের জনপদ। যেখানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর গুম-খুন-অপহরণে এক ভীতিকর অবস্থা পাহাড়জুড়ে। গুম-খুন-অপহরণ আর সর্বগ্রাসী চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে পাহাড়ি জনপদ দিন দিন পরিণত হচ্ছে আতঙ্কের লোকালয়ে। এতে একদিকে পাহাড়ে যেমন শান্তি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়ছে পর্যটন শিল্প। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে এখন তাই একাট্টা পাহাড়ি বাঙালি সবাই।
সরকারি হিসাব ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিগত এক বছরে বৈচিত্র্যময় জেলা রাঙ্গামাটিতে ১৫ জনকে খুন করার পাশাপাশি অর্ধশত লোককে অপহরণ করেছে আঞ্চলিক দলীয় পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তবে রাঙ্গামাটি পুলিশের হিসাব মতে, চলতি বছর ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এই মাসেই খুনের তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে আরো তিনটি নিহতের ঘটনায়। তারমধ্যে গত ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও জুড়াছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দু চাকমা, একই দিনে জেলার নানিয়ার চরে স্ব-জাতি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয় সাবেক জনপ্রতিনিধি অনধি রঞ্জন চাকমা। এই দুইটি ঘটনার মাত্র ১০দিন পর ১৬ ডিসেম্বর সদর উপজেলাধীন বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় অনল বিকাশ চাকমা ওরফে প্লুটো চাকমা। সে ইউপিডিএফের বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের সংগঠকের দায়িত্বে ছিল বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, বিগত বছরগুলোতে খুন-গুমের ঘটনা থেমে থেমে চললেও চলতি বছরের শেষাংশে এসে খুন-গুমের ঘটনা হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে অপহরণের ঘটনা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এবং চাঁদা আদায়ের কারণে সংগঠিত অপহরণ ঘটনাগুলোর অধিকাংশেরই কোনো মামলা হয় না স্থানীয় থানাগুলোতে। প্রাণের ভয়ে ভ‚ক্তভোগীরা মামলা থেকে দূরে থাকে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। যার ফলে এই হিসাব পুলিশের খাতায় তেমন একটা উঠে আসে না।
পুলিশের সূত্র মতে, রাঙ্গামাটিকে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে অহরণের ঘটনা ঘটেছে মাত্র পাঁচটি। বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে রাঙ্গামাটিতে অহরণের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধি মিলে অন্তত অর্ধশত লোকজন। অপহরণের মিছিলে সর্বশেষ যোগ হয়েছে ২১ ডিসেম্বর দুপুরে নানিয়ার চর উপজেলার অন্তত ২২ ইউপি সদস্যকে সদর উপজেলাধীন বন্দুকভাঙ্গার ভাঙ্গামোড়া এলাকায় ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। এই ঘটনার পরবর্তী দুইদিনে সবাইকে ছেড়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেলেও কেউই মুখ খুলছে না।
রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে যারা অভিযোগ করেন সেগুলোর হিসাবই রয়েছে। এই মোতাবেক ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযান চলমান রয়েছে।
অভিযোগ আছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কলা, আনারস, কাঁঠাল বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসীদের বিপুল অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। তাতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও তা নিয়ে মুখ খুলতে ভয় ভ‚ক্তভোগীদের। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে চাঁদাবাজি।
স্থানীয়ভাবে কাজ করা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে পাহাড়ে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অবৈধ চাঁদাবাজি। স্থানীয়দের তথ্য মতে, শুধু রাঙ্গামাটিতেই বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারার কারণেই সম্প্রতি আরো একটি সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে পার্বত্যাঞ্চলে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায়ের কারণেই অত্রাঞ্চলের এক শ্রেণীর উপজাতীয় সন্ত্রাসী তাদের অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে বছরের পর বছর চাঁদা আদায় করে সেগুলো দিয়ে ক্রয় করছে বিপুল অবৈধ অস্ত্র। এই অস্ত্রের অহরহ ব্যবহারের কারণেই পাহাড়ে বন্ধ হচ্ছে না সশস্ত্র কার্যক্রম। আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অতিষ্ঠ হয়ে এবার মুখ খুলছেন স্বয়ং সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দ। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে এখানকার আঞ্চলিক দলগুলো এমন অভিযোগ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপঙ্কর তালুকদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, চুক্তি সম্পাদনকারী দল জেএসএস তাদের আগেকার মতো সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ না করে উল্টো সশস্ত্র কার্যক্রম বৃদ্ধি করে পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের রামরাজত্ব কায়েম করেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়। তাই পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হলে পাহাড়ে সর্বাগ্রে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, অস্ত্রের ব্যবহারে সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম আর শান্তিপ্রক্রিয়া একসাথে কখনো চলতে পারে না।
এদিকে, জাতীয় সংসদের ৩৩৩ নং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএসের সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা ঢাকায় বসে ঘোষণা দেয়ার পরপরই রাঙ্গামাটিতে তিনটি হত্যার ঘটনা ঘটল এবং আওয়ামী লীগের বিলাইছড়ি উপজেলার সহ-সভাপতি রাসেল মারমা ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ঝর্ণা চাকমাকে হত্যার চেষ্ঠা চালিয়ে গুরুতর আহত করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে জেএসএসের সন্ত্রাসীরা। তিনি বলেন, পাহাড়ে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের অব্যাহত সশস্ত্র কার্যক্রমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একের পর খুন-গুম-অপহরণসহ নিয়ন্ত্রণহীন চাঁদাবাজিতে পাহাড়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নেয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। শীঘ্রই পার্বত্যাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান পরিচালনার দাবি করে এমপি চিনু বলেন, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে যে কোনো সময়। সেসময় হয়তো বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। তাই সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামার আগেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পাহাড়ে বিশেষ অভিযান শুরুর দাবি জানিয়েছেন ফিরোজা বেগম চিনু।
রাঙ্গামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী বলেছেন, আমরা রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চাইনা। শান্তিচুক্তি অনুসারে সুন্দর একটি রাঙ্গামাটি গঠনের আমরা সবাই কাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমরা দেখছি, সাম্প্রদায়িক মহল অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে অত্রাঞ্চলের জনজীবন বিঘিœত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে সরে এসে সন্ত্রাসমুক্ত রাঙ্গামাটি বিনির্মাণে সবাইকে অস্ত্র ছেড়ে শান্তির পথে আসার আহŸান জানিয়েছেন মেয়র।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক আলহাজ মূছা মাতব্বর বলেছেন, একদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন চাইবেন, অন্যদিকে সশস্ত্র কার্যক্রম চালাবেন এইটা তো চলতে পারে না। তিনি বলেন, হয় অস্ত্র থাকবে, না হয় শান্তিচুক্তি থাকবে। দুইটি জিনিস একসাথে চলতে পারে না। পার্বত্য এলাকাকে মগের মুল্লুকে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কতটা অসভ্য হলে একটি জেলায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে বাধা দিতে পারে। এই ধরনের সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে এক কাতারে এসে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী ২৮ জানুয়ারি রাঙ্গামাটি শহরস্থ জিমনেসিয়াম মাঠে মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। এই কর্মসূচি থেকে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা আসবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নিজেদের অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় নিজেদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে উন্নয়নের স্রোতধারায় ফিরে আসার কথা দেয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএসের সাথে শান্তিচুক্তি করে তৎকালীন সরকার। চুক্তির মাত্র ২০টি বছর অতিবাহিত হওয়ার সন্ধিক্ষণে সেই বন্ধুদের অস্ত্রের নলে এলাকা ছাড়া হচ্ছে সরকারদল আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে পাহাড়ের ভোটকেন্দ্রে পোলিং অ্যাজেন্ট দেয়ার মতো কর্মী খুঁজে পাবে না স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বর্তমান সরকারের ধীরে চলো নীতিকে পুঁজি করেই পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে বলে মনে করছে স্থানীয় মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ