ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ভারতের সংস্কৃতিতে ইসলামি কৃষ্টির অবদান সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে আলোচনা করতে হয় ভারতীয় সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। আর এই আলোচনায় একটা কথা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, এই সভ্যতা মূলত ধর্মভিত্তিক। বৈদিক যুগ থেকে আরম্ভ করে মুসলমানদের আগমন পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের যে ধারাটি অব্যাহত ছিল, তা হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত ছিল। মুসলমানদের আগমনের পরে ইসলাম ধর্মও এই সভ্যতার আরেকটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কাজেই হিন্দু এবং ইসলাম এই দুই ধর্মই এই সভ্যতার মূল ভিত্তি। কিন্তু এ কথা অবশ্যই উল্লেখ্য যে, এই দুটি ধর্ম আবার ভিন্নমুখী। ‘ব্রহ্মসত্য, জগৎ মিথ্যাই হল হিন্দু জীবন দর্শনের মূল মন্ত্র। কিন্তু ইসলাম নিয়ে এল এক ভিন্ন জীবনাদর্শ। ইসলাম জীবনাদর্শে ইহ এবং পারলৌকিক কল্যাণ সাধনের মাহাত্ম্য সগর্বে ঘোষিত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় বারশ’ বছর কাল ধরে ইসলামি সভ্যতা ভারতের ইতিহাসের ধারাকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকগণ তাদের কীর্তি, তাঁদের প্রেম, তাঁদের শিল্পানুরাগ প্রভৃতিকে কালজয়ী করতে গিয়ে সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের ইতিহাসে এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তার ফল হিসেবে জন্ম নিয়েছে এক মিশ্র সংস্কৃতি, সমাজ ও শিল্প। এক্ষেত্রে দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবর লিখেছেন, ‘হিন্দুরা তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ। মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রঙমহল। হিন্দুরা সাধক, তারা দিয়েছে দর্শন। মুসলমানদের গুণ তারা দিয়েছে সঙ্গীত। হিন্দুরা গর্ব মেধার, মুসলমানের গৌরব হৃদয়ের। এই দুই নিয়েই ছিল ভারতবর্ষের অতীত, এই দুই নিয়েই হবে তার ভবিষ্যৎ।’ যাযাবরের এই উক্তিটি আংশিক সত্য। কিন্তু সমাজ জীবনে এই দুই ভিন্নমুখী সভ্যতার সংমিশ্রণে যে মিশ্র কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে, তাকে এত সহজে পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। যদিও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতেই ইসলামি সভ্যতার ঢেউ ভারতের সনাতন সভ্যতার বেলাভূমি স্পর্শ করেছিল, তথাপি ইসলাম ধর্মালম্বী তুর্কী-আফগানদের রাজত্বকালেই ইসলামি সভ্যতা জীবন সাহিত্য সমাজ এবং ধর্মকে বিভিন্নভাবে প্রবাভিত করেছিল। তারপর মোগল সম্রাটগনের রাজত্বকালে এর চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। কাজেই মুসলমানদের দীর্ঘ রাজত্বকালের মধ্যে দুই বিপরীত মুখী সভ্যতার সংমিশ্রণে এক নতুন ভাষার উৎপত্তি ভারতীয় ভাষাগুলোর সমৃদ্ধি, ধর্মীয় সংস্কার, সমাজ এবং রাজনৈতিক জীবনে নতুন চিন্তাধারার উন্মেষ, কারুশিল্প এবং সংগীত শিল্পের উন্নতি এবং পোশাক পরিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নতুন নতুন উপকরণের সমাবেশ প্রভৃতি ভারতীয় সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। মুসলমানগণ সমাজ ও সংস্কৃতির যে ভাবধারা নিয়ে ভারতে এসেছিল, তার উপাদানগুলো কিন্তু আরব এবং পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। মুসলমানদের ভারত বিজয়ের পূর্বে ইসলাম ধর্মালম্বী আরবগণ পারস্য সা¤্রাজ্য অধিকার করেছিলেন। কিন্তু তারা বিজেতা হলেও বিজিত পারসিকগণের অপেক্ষাকৃত উন্নত সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে তাদের মৌলিকত্ব অনেকটা ক্ষুণœ হয়েছিল। ভারতীয় ইতিহাসে এটাই ইসলামি সংস্কৃতি নামে পরিচিত। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে যে ভারতীয় ভাষাটির বিশেষ অবদান রয়েছে, তা হল উর্দুভাষা। মুসলমান আমলের রাজ কবিদের থেকে আরম্ভ করে মীর্জা আসাদুল্লা গালিব এবং সম্প্রতিকালের ফিরাক গোরক্ষপুরী প্রমুখ অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিকের লেখনী নিসৃত সাহিত্য সম্ভারে এই ভাষা সমৃদ্ধ। তাছাড়া এই উর্দু ভাষার জন্মের সঙ্গে অনিবার্যভাবে জন্ম নিয়েছিল উর্দু গজলের যা ভারতীয় সংগীতের জগতে এক নতুন দিক চক্রবালের উন্মোচন করেছে। এই ভাষায় সুফীদের ধর্মমত প্রচার এবং উপাসনার মন্ত্রগুলোও সাহিত্যিক মর্যাদাসম্পন্ন। এই উর্দুভাষা ভারতের ভাষার ইতিহাসে ইসলামি সভ্যতার এক বিরাট অবদান। তুর্ক-আফগান যুগে হিন্দু মুসলমানের কৃষ্টির মিলনে এই ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। একই দেশে ফার্সিভাষী মুসলমান এবং হিন্দীভাষী হিন্দুদের বসবাসের ফলে তাদের মানবিক প্রয়োজনে একটি সাধারণ ভাষার প্রয়োজন হল এবং প্রয়োজনের তাগিদই জন্ম দিল উর্দু ভাষার। আজও উপমহাদেশে কয়েক কোটি লোকের মাতৃভাষা উর্দু। ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইসলামি কৃষ্টির পরোক্ষ অবদান হল প্রাদেশিক ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি। রক্ষণশীল হিন্দুগণ প্রায়ই সংস্কৃত ভাষায় পুস্তকাদি রচনা করতেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মের প্রভাবে লোকায়ত ধর্ম মতের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল লোকায়ত ভাষায় ধর্মমত প্রচারের প্রয়োজনীয়তা। ধর্ম সম্প্রসারকগণ তাঁদের উপদেশাবলী সহজতর করার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহার করতে লাগলেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার প্রাদেশিক ভাষায় পুস্তাকাদি রচনা করতে লাগলেন। তাঁদের শিষ্যদের মধ্যে অনেকে গুরুদের অনুসরণ করলেন। এর ফলে বাংলা, অসমিয়া, হিন্দি, মারাঠী, গুরুমুখী প্রভৃতি ভাষা বিশেষ উন্নতি লাভ করে। তাছাড়া ইসলাম, ধর্মাবলম্বী শাসক গোষ্ঠীর ধর্মীয় ভাষা আরবী এবং রাজদরবারের ভাষা ফার্সির অনেক শব্দ নানাবিধ লৌকিক কারণে ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে এমনভাবে অনুপ্রবেশ করে যে, এইগুলোকে আজ বিদেশী শব্দ বলেই মনে হয় না। এর ফলে ভারতীয় ভাষাগুলোর শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধি লাভ করে।
ভারতীয় ধর্ম এবং রাজনৈতিক জীবনে ইসলামি ভাবধারা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। মুসলমানদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম ধর্মের প্রচার আরম্ভ হয় এবং অনেক লোক এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। ইসলাম ধর্মের এই প্রচারের ফলে সনাতন ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়। অধ্যাপক খালিক আহমদ নিজামীর মতে, ‘ঈশ্বরের একত্ব এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব এই যে দুই মৌলনীতির উপর মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠিত, তা হিন্দুমনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।’ ভারতের ধর্ম জগতে ভক্তি আন্দোলন বহুলাংশ ইসলামিক দর্শনের প্রভাবের ফল। মুসলমান সুফীগণ যেমন ভারতীয় দর্শনের মূল মন্ত্রে অনেকটা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি মধ্যযুগের রামানন্দ, কবির, নানা, শ্রীচৈতন্য এবং শঙ্করদেব প্রভৃতি ভারতীয় দর্শনের সংস্কারকগণ ইসলামের একত্ববাদের মন্ত্রের মধ্যে বৈদিক ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল সুরটি আবার খুঁজে পেয়েছিলেন। এমন কি পরবর্তী কালে রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মীয় আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের আখড়া পদ্ধতির সৃষ্টি হয়। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এই বিশাল ভূখন্ডে একই সভ্যতা থাকলেও রাজনীতি, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির বিভিন্নতা ভারতকে অনেকগুলো ভৌগোলিক খন্ডে বিভক্ত করে রেখেছিল। কিন্তু ইসলাম ধর্মের প্রচারের ফলে আসমুদ্র হিমাচলে একাত্ববোধের চেতনা দেখা দিল। মুসলমান শাসকগণের সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা বিচ্ছিন্নতাকামী প্রবণতাকে অনেকটা দূরীভূত করেছিল। সুলতানী আমলে বিজিতদের ধর্ম এবং আচার অনুষ্ঠানের প্রতি শাসকদের মনে ঘৃণা থাকলেও ইসলাম একাত্ববোধ এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের দ্বারা এক ইসলামি রাজ্য কায়েম করার চেষ্টার ফলে সর্বভারতীয় কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিতে একাত্ববোধের প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলমানদের প্রতিমা বিনাশী প্রবণতা রাজনৈতিক প্রয়োজনে অনেকটা দূর হয়েছিল এবং তারা ইসলামি গোঁড়ামি অনেকটা ক্ষুণœ করে হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে অনেকটা সফলকাম হয়েছিল। এই ‘দিবে আর নিবে, মিলবে মিলাবে’ নীতির ফলে সর্বভারতীয় কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিতে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। ইসলামি কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে একটা যোগসূত্র।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।