Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুশ্রম বন্ধে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শিশুশ্রম জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ৭ বছরের শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৪, যার মধ্যে কর্মক্ষম শিশুর সংখ্যা হলো সাড়ে ৩৪ লাখ, যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে। এদের মধ্যে ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। আর প্রায় ১৩ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। এসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে তাদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা দেশের সংবিধানের মৌলিক ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, মোট কর্মক্ষম শিশুদের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ২৪ লাখ ৭০ হাজার, শহরে ৫ লাখ ৭০ হাজার এবং সিটি করপোরেশনে ৪ লাখ ৩০ হাজার। এদের মধ্যে ছেলে শিশু হলো ২১ লাখ এবং মেয়ে শিশুর সংখ্যা হলো সাড়ে ১৩ লাখ। এসব শিশু শ্রমিক কাজ করছে বাসাবাড়িতে, কৃষিতে, উৎপাদনমুখী শিল্পে, নির্মাণ শিল্পে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়, পরিবহনে। কৃষিতে ৩৬.৯ শতাংশ, উৎপাদনমুখী শিল্পে ২৭.৩ শতাংশ, বন বিভাগ, মৎস্য খাতে ২৭.৪৬ শতাংশ, ১৭.৩৯ শতাংশ কাজ করছে সেবা ও পণ্য বিক্রিতে। তবে বিবিএসের ২০০৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় দেখা গেছে, তখন প্রায় ৭৪ লাখ কর্মরত শিশু ছিল। তাদের মধ্যে ৩১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় ছিল। এক দশকের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা কমেছে মাত্র ১১ হাজার। ২০০৩ সালে দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ছিল।
এ দিকে, ১৮তম আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এই শ্রম অনুমোদনযোগ্য। আর ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে তা শিশুশ্রম হবে। ওরাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে। অন্য দিকে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, তা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।
বিবিএসের জরিপের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন শিশু ‘শিশুশ্রমে’ নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ জন মেয়ে শিশু। শিশুশ্রম বেশি দেখা গেছে কৃষিক্ষেত্রে ও কলকারখানায়, সেখানে ১০ লাখের বেশি শিশু কাজ করে। সবচেয়ে বেশি সাড়ে পাঁচ লাখ শিশু উৎপাদন খাতে বা কলকারখানায় কাজ করে। আর কৃষি খাতে কাজ করে পাঁচ লাখ সাত হাজার শিশু। দোকানপাটে ১ লাখ ৭৯ হাজার শিশু, নির্মাণশিল্পে ১ লাখ ১৭ হাজার শিশু কাজ করে। শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের ৫৭ শতাংশের কাজই অস্থায়ী। বর্তমানে শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে এমন ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু একসময় স্কুলে গেলেও এখন আর যায় না। আর ১ লাখ ৪২ হাজার শিশু কখনোই স্কুলে যায়নি। এসব শিশুর সবাই দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারের নেয়া নতুন কর্মসূচি হিসেবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ হাজার শিশু, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০ হাজার শিশু, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার শিশু এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রকল্পটির কাজ দেশের ১৪টি জেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। আর সেগুলো হলো কুমিল্লা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও চট্টগ্রামে।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইতোমধ্যে দেশের তৈরি পোশাক খাত ও চিংড়ি রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাগুলোয় পুরোপুরিভাবে শিশুশ্রম মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তারা স্বীকার করছেন, কৃষি খাতসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে অনেক শিশু শ্রমিক হিসেবে এখনো নিয়োজিত রয়েছে।
আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে শিশুশ্রম কমছে, তবে তা প্রত্যাশিত নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। এই শ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম বন্ধে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে জোরালভাবে তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করতে হবে। জাতীয় শিশুনীতিতে এটা স্বীকার করা হয় যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের কোনো ভেদ নেই। শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের পাশাপাশি দেশের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। যে সমস্থ কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান শিশুদের শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করে তাদের ব্যাপারে সবার আগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাথে সাথে দেশের প্রতিটি মা-বাবা কে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের কাজে নিয়োগ না করে বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের চেয়ে শহরে বেশির ভাগ শিশুশ্রম বেশি দেখা যায়। তার কারন আর্থিক দূরবস্থা। তাছাড়া সেখানে তাদের দেখাশুনা করার মতো কোন সচেতন লোক না থাকার কারণে তারা বিদ্যালয়গামী না হয়ে শ্রমসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন