Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশু হত্যার শেষ কোথায়?

অ ভি ম ত

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমরা বড্ড কঠিন সময়ের মধ্যে দিনপাত করছি। আমাদের সমাজ এখন বিপর্যয়ের প্রান্তিক উপনীত হয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা বাসা বেঁধে বসেছে। শিশু নির্যাতন, শিশুহত্যা, শিশু ধর্ষণ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ভয়াবহরূপে প্রকাশিত হয়েছে। একের পর এক নিষ্ঠুর পৈশাচিক ঘটনা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অপরাধী করছে। শিশু পৃথিবীর আলো দেখামাত্র চিৎকার করে তার মায়ের কোলে নিরাপদ আশ্রয় তালাশ করে। মা যখন শিশুকে বুকে টেনে নেয় তখন শিশু নিজেকে সুরক্ষিত মনে করে। কিন্তু আজ নিজ মায়ের কাছেও শিশু নিরাপদ নয়।মানবিকতার অধঃপতন কোন স্তরে নামলে পরে মা তার পাপ ঢাকতে কলিজার টুকরা সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করতে পারে, তা বুঝার জন্য গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। 

একটি সমাজের চেহারা ভালো নাকি মন্দ তা পরিমাপ করার জন্য দাঁড়িপাল্লার প্রয়োজন নেই। দেশ-সমাজের সাবির্ক পরিস্থিতি একটু বিশ্লেষণ করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় শিশুর কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতি তার উল্টো স্্েরাতে ভাসছে। দেশের শিশুরা আজ শামুকের মতো নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেননা প্রতিদিন সংবাদের পাতায় চোখ বুলালেই হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, মা-বাবার হাতে ছেলেমেয়ে, ছেলেমেয়ের হাতে মা-বাবা, ভাইয়ের হাতে বোন, বোনের হাতে ভাইয়ের খুন হওয়ার মতো ঘটনা মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানি আমলে এত দেখা যেত না। বাংলাদেশে সত্তর ও আশির দশকেও এমন নির্মম নিষ্ঠুরতার কথা এখনকার মতো এতো শোনা যেত না। কিন্তু এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, পিতামাতার কাছে সন্তান,সন্তানের কাছে পিতা-মাতা নিরাপদ নয়। এই বিষয়টি ভাবনার দায়িত্ব যেমন ব্যক্তিবিশেষের,তেমনি সমষ্টিগত দিক থেকে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর। দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করা ক্ষমতাসীনদের নৈতিক দায়িত্ব । জীবন ও ইজ্জতের নিরাপত্তাহীনতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষ তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এখনও দেখতে পারেনি। পৃথিবীর যে কোনো দেশে অপরাধ যখন পারিবারিক পর্যায়ে নিষ্ঠুরভাবে ঘটতে খাকে, তখন সেই সমাজ বা রাষ্ট্রের জনগণ এক মহাসংকটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। প্রতিটি রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকেন তারা যদি নিজেরা সৎ জীবনযাপন করেন, চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ লুটপাট থেকে বিরত থাকেন তাহলেই কেবল সমাজ ও রাষ্ট্রের জনগণের জীবন স্বাভাবিক থাকে।
সভ্য সমাজের মানুষেরা যেখানে শিশুদের জন্য বাস উপযোগী পৃথিবী গড়ে তুলতে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে একশ্রেণীর মানসিক বিকারগ্রস্থ নিষ্পাপ শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। যেভাবে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকান্ড যত্রতত্র অহরহ সংগঠিত হচ্ছে তা সভ্য সমাজে নজিরবিহীন। সম্প্রতি যে নৃশংস ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে তার কিছু পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হলো।শিশু রাজন, রাকিব, সামিউল, আব্দুল্লাহর খুনের স্মৃতি এখনো মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে সর্বশেষ করুণতম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে রাজধানীর বাড্ডায়। গত ৩১ অক্টোবর মধ্যরাতে মা আরজিনা আর তার প্রেমিক শাহীন শিশু নুসরাত ও তার বাবাকে হত্যা করে। নিকট অতীতে নরসিংদীর আলোকবালির পূর্বপাড়া গ্রামে আপন ভাই তার তিন ভাই-বোনকে গলা টিপে হত্যা করে। সাত বছর আগে ২০১০ সালের ২১ জুন রাজধানীর আদাবরে মা আয়শা হুমায়রা নিজ হাতে গলাটিপে শিশুসন্তান খন্দকার সামিউল আজিমকে হত্যা করে। সামিউলের অপরাধ সে তার মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলে এবং তা বাবাকে বলে দেয়ার কথা বলে। গত বছর বনশ্রীতে মাফুজা নামের এক মা হত্যা করে তার বার ও সাত বছর বয়সী সন্তান অরনী ও আলভাকে। ১ অক্টোবর বুধবার রাজধানীর কাকরাইলে দুর্বত্তদের হাতে খুন হন মা-ছেলে। পরদিন বাড্ডায় খুন হন বাবা-মেয়ে। পরকীয়া দেখে ফেলার অপরাধে গত ২৭ অক্টোবর নরসিংদীর শিবপুরে চাচী তমুজা বেগম হাত পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করে ১৩ বছরের কিশোরী আজিজাকে। গত ২৯ অক্টোবরে রাজধানীর চকবাজারে কিশোরকে চাকু মেরে হত্যা করা হয়। বিষয় তুচ্ছ। সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে দ্ব›দ্ব। সম্প্রতি ময়মনসিংহের শ্রীরামপুরে সাগর নামে এক কিশোরকে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১ নভেম্বর উত্তর বাড্ডার ময়নারনগর এলাকার একটি বাসায় জামিল শেখ ও তার মেয়ে নুসরাত খুন হন। ঘাতক কোন দূর্বত্ত কিংবা কিলার নন,স্ত্রী আরজিনা। ১ নভেম্বর রাতে একই বিছানায় শুয়ে ছিল জামিল, আরজিনা, নুসরাত। স্ত্রী আরজিনা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘরের দরজা খুলে ঘুমায় যেন কথিত প্রেমিক শাহিন ঘরে প্রবেশ করতে পারে। স্বামী ও মেয়ে নুসরাত ঘুমিয়ে পড়ার খানিক পরে প্রেমিক শাহিন বাসার নিচ থেকে একটি কাঠের টুকরা এনে ঘরে ঢুকে জামিলের মাথায় আঘাত করে। প্রথম আঘাতের পর জামিল উঠে যায় এবং জিজ্ঞেস করে কেন তাকে আঘাত করা হচ্ছে। এরপর শাহিন কোনো কথা না বলে আরও কয়েকটি আঘাত করে হত্যা নিশ্চিত করে। এসময় ঘুম থেকে জেগে ওঠে মেয়ে নুসরাত। সে শাহীনের কাছে বাবাকে কেন মারা হলো তা জানতে চায় এবং চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকে। বাবাকে হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলায় মেয়ে নুসরাতকেও খুন করে খুনী শাহীন। আর এভাবেই পরকীয়া প্রেমের জেরে বাবা-মেয়ের জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্নে প্রেমিককে নিয়ে স্বামী-মেয়েকে খুন করে আরজিনা। হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেফতার স্ত্রী আরজিনা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মায়ের পরকীয়ার কাছে হার মেনে পরিণত বয়সের আগেই নুসরাতকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। কোনো রোগে কিংবা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি নুসরাতের। তাকে ঠান্ডা মাথায় নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে পৃথিবীর কুৎসিত রুপটি সে দেখেছে। ৫ নভেম্বর ২০১৭ খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের আইতলা গ্রামে সৎ মায়ের প্ররোচনায় নিষ্ঠুর এক বাবা তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে লাবণীকে গোয়ালঘরে বেঁধে নির্যাতন করে। শিশু লাবণীর প্রতি অবহেলা ও তাকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে তারা বাবা আফজাল খান ও সৎমা রুপা বেগম ও দাদি মর্জিনা বেগমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটে চুরির অভিযোগে শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট খুলনায় হত্যা করা হয় রাকিবকে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পানির পাম্প চুরির অভিযোগে মোমেনশাহীতে সাগর নামে এক কিশোরকে হত্যা করা হয়। ৪ নভেম্বরে লক্ষীপুরের রায়পুরে ল্যাপটপের গেম মুছে ফেলার অভিযোগে শিশু পিয়াসকে নির্যাতন করা হয়। ৬ নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় জেএসসি পরীক্ষীর্থী প্রিয়াংকাকে গলা কেটে হত্যা করেছে এক বখাটে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে রাজধানীর ভাসানটেক থানা এলাকায় মোবাইল ও টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে শুভ নামের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরই শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা সদরে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে ফিরোজ সরদার নামের এক যুবকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বরে যশোরের কেশবপুরে শরিফুল ইসলাম নামের এক শিশুকে চুরির অভিযোগে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৫ নভেম্বরে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় দেড় মাসের শিশুকে খুন করা হয়েছে। জামালপুরের ইসলামপুরে পারিবারিক কলহের জের ধরে মায়ের পান করানো বিষে মৃত্যু হয়েছে মরিয়ম আক্তার নামের এক শিশুর।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ক্রমেই অজানা গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে ক্ষমতাসীনরা যদি চেষ্টা তাহলে সমাজ থেকে এই বিষবাষ্প দূর করা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থায় ও ইসলামী মূল্যবোধের সন্নিবেশের বিকাশ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন