ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ব্যবসায়ী, গ্রাহক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের বিরোধিতা উপেক্ষা করে আবারও গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই নিয়ে সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত বছরে খুচরা গ্রাহক বা ভোক্তা পর্যায়ে আটবার এবং পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে এই দামবৃদ্ধি কার্যকর হবে। এতে সরকারের বাড়তি আয় হবে ১৭০০ কোটি টাকা। কেন ও কী কারণে বিদ্যুতের দাম আবার বৃদ্ধি করা হলো, তার কোনো সন্তোষজনক জবাব বিইআরসি দিতে পারেনি। বলা হয়েছে, খুচরা পর্যায়ে ৫.৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুতের ন্যূনতম বিল প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। মাসে ৫০ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করা ৩০ লাখ দরিদ্র গ্রাহকের বিল এতে কমবে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের মাসিক বিল বাড়বে না। বিইআরসির (বিদ্যুৎ) এক সদস্য জানিয়েছেন, সরকারের ভর্তুকি বছরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা অনুদান দেয়ার বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম কমানোসহ অন্যান্য বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। তাই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়েছে। বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধিকে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে বিইআরসির কেউই যৌক্তিক প্রমাণ দিতে পারেননি। তারপরও মূল্য কি করে বাড়ে? এটা কেবল আমাদের মতো দেশের প্রেক্ষাপটেই সম্ভব। এর সাথে ন্যয়নীতি, ভোক্তাদের স্বার্থ-অধিকার ও আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। গণশুনানি যে এক ধরনের প্রহসন এবং আকর্যকর ও অর্থহীন, তা মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক ও স্বস্তিকর জীবনযাপনের পরিবর্তে প্রচÐ টানাপড়েনের মধ্যে তারা নিপতিত। খরচের খাত কাটছাঁট করেও স্বস্তি পাচ্ছে না। এর উপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ধুঁকতে থাকা সাধারণ মানুষের খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমে এসেছে। এতে তাদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে। শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে পণ্যমূল্যও আকাশ ছোঁয়া হবে। এর সব দায়ভারই নিতে হবে সাধারণ মানুষকে। সরকারের তরফ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড অত্যন্ত গর্ব সহকারে ঘোষণা করা হয়। অথচ এর সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। উল্টো বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জনসাধারণের উপকারার্থে নয়, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের ব্যবসায়িক মনোভাবই প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। দায়মুক্তি দিয়ে বেসরকারি খাতে বিনা টেন্ডারে তরল জ্বালানি নির্ভর কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সরকার তাতে কান দেয়নি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে এবং এখনো কিনছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের চাপে পড়ে সরকারও ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে চলেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন। এসব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যখন অনুমোদন দেয়া হয়, তখন বলা হয়েছিল, এটা স্বল্প সময়ের জন্য করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এসব ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। আট বছর পার হয়ে গেলেও মধ্যমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য জনসাধারণের উপর বোঝা হয়ে চেপেছে। দামবৃদ্ধি করে সরকার লাভবান হলেও জনসাধারণ পড়েছে চরম দুর্ভোগে। অভিযোগ রয়েছে, সরকার পিডিবির কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। এ থেকেও সরকারের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি প্রকাশিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে যখন জ্বালানি তেলের দাম সর্বকালের সর্বনি¤œ পর্যায়ে রয়েছে, তখন সরকার দেশে তেলের দাম কমায়নি। অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানোর জন্য দফায় দফায় দামবৃদ্ধি করে গ্রাহকদের পকেট কেটে নিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি ও পুনরায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলেও সেদিকে সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। বিদ্যমান ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুতের উপরই নির্ভর করে চলছে এবং ঘাটতি পূরণের নামে মূল্যবৃদ্ধি করে জনসাধারণকে ক্রমাগত শোষন করে যাচ্ছে।
অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই হয় না, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ও যথাযথভাবে সরবারাহের উপরই এর সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে। জ্বালানি তেলের স্বল্পমূল্যের এ যুগে অধিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের তা সরবরাহ করার সুযোগ হাতছাড়া করা হচ্ছে। সুযোগ থাকা সত্তে¡ও জনসাধারণকে কষ্টের মধ্যে ফেলে একের পর এক বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সৃষ্টি করা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে, বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির গতি ধীর রেখে এবং দামবৃদ্ধি করে তা অর্জন করা সম্ভব নয় বলে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, নেপাল ও ভুটান বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এ প্রতিবেদন থেকে এটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার যে বিপুল সাফল্য অর্জনের কথা বলে উল্লাস প্রকাশ করছে, তা বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। সরকারের কথা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য হলে জনসাধারণ সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেত। দফায় দফায় দামবৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ত না। আবার বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের সাথে যদি তাল মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতো, দাম কমাতো তবে গ্রাহকদের দামবৃদ্ধির এই চাপে পড়তে হতো না। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে তা সাশ্রয়ী করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল, তার কোনো কিছুই সরকার করেনি। সরকারের মনোযোগ হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে জনসাধারণের সঙ্গে ব্যবসা করা যা অনুচিত ও খারাপ দৃষ্টান্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।