Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জেলেদের ডালায় অসংখ্য বোয়াল

| প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম


সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : নরসিংদী ও উজান মেঘনায় এ বছর বোয়াল মাছের আধিক্য দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই মেঘনা ও মেঘনা সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে ব্যাপকহারে বোয়াল মাছ ধরা পড়ছে। নরসিংদীসহ দেশের মাছ বাজারগুলোতে জেলেদের ডালায় ডালায় বিক্রি হচ্ছে ছোটবড় অসংখ্য বোয়াল মাছ। দীর্ঘ চার দশকাধিককাল মেঘনাসহ প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বোয়াল শূন্যতার পর হঠাৎ বোয়াল মাছের এই সংখ্যাবৃদ্ধি মৎস্য গবেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। আশ্চর্যান্বিত করে দিয়েছে জেলেদেরকে। তারা বুঝতে পারছে না এত বোয়াল কোত্থেকে এসেছে। মাছের বাজারগুলোতে বোয়াল মাছের আমদানী নিয়ে চলছে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক আলাপ আলোচনা।
বোয়াল মাছ বাঙালী সমাজের একটি অতি জনপ্রিয় মাছ। ‘মাছে-ভাতে বাঙালী’ এ দেশে বোয়াল মাছ চিনেনা এমন লোকের সংখ্যা কম। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের নিকটই বোয়াল মাছের রয়েছে বিশেষ কদর। এক সময় বাংলাদেশের নদ নদী খাল বিল, হাওড় বাওড়সহ সকল প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর সংখ্যক বোয়াল মাছ পাওয়া যেতো। পাতা বড়শি, কোচ, টেটা, পলোয়া এবং বিভিন্ন প্রকার জাল দিয়ে বাঙালীরা এ মাছ শিকার করতো। বোয়াল মাছ দেখতে সুন্দর খেতে সুস্বাদু। রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এ মাছের কোন অংশই ফেলনা নয়। লোলা-জোলা (পাকস্থলি ও আতুড়ি ভূতুড়ি) পর্যন্ত খাওয়া যায়। গ্রামের মহিলারা বোয়াল মাছের পাকস্থলি আতুড়ি ভুতুড়ি, ফুলকা, কলিজা ইত্যাদি খন্ড খন্ড করে কেটে একত্রে পিঁয়াজ, কাচামরিচ, ও রসুন দিয়ে কাঁচা ভূনা তৈরী করে খায়। বোয়াল মাছের লেজ ও পেটি একত্রে কেটে কাঁচা ভূনা খুবই সুস্বাদু খাবার হিসেবে পরিচিত। বোয়াল মাছের মাথা, কচুর ছড়ি এবং জলপাই দিয়ে খাট্রা রান্না করে খেলে বাঙালী সংসারে নাকি চাল বেশী লাগে। শীতের দিন দেশী আলু ও বোয়াল মাছ ও দু/একটি টমেটো একত্রে রেধে রেখে দিলে সকালে জমে সর পড়ে থাকে। এই সর পড়া তরকারী আর ঠান্ডা কড়কড়া ভাত বাঙালীর খুবই প্রিয় খাবার।
কিন্তু এত চাহিদা সত্বেও বোয়াল মাছ পাওয়া যাচ্ছে খুব কম। বিগত চার দশকাধিক কাল ধরে বোয়াল মাছ প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে বিলুপ্ত প্রায় হয়ে গিয়েছিল। তালিকাভূক্ত হয়ে গিয়েছিল বিলুপ্ত প্রায় মাছ হিসেবে। ২০০৪ সালের বন্যার পর থেকে মেঘনায় বোয়ালের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। এর পর থেকে জেলেদের জালে কিছু কিছু বোয়াল মাছ ধরা পড়তে থাকে। মেঘনাসহ সকল প্রাকৃতিক জলাশয় বোয়াল শূন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু এ বছর সবাইকে তাক লাগিয়ে মেঘনায় বোয়ালের সংখ্যা আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে। চলতি বছর মেঘনায় পানি বাড়ার সাথে সাথে জেলেদের জালে ধরা পড়তে থাকে বোয়াল মাছের হাজার হাজার পোনা। নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন মাছ বাজারগুলো বোয়াল মাছের পোনায় সয়লাব হয়ে যায়। এ নিয়ে দৈনিক ইনকিলাব কিছুদিন পূর্বে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। অবাধে বোয়ালের পোনা নিধনের পরও বাজারে বোয়ালের আমদানী কমছে না। প্রতিদিনই জেলেদের ডালায় উঠে আসছে ছোট ও মাঝারী আকারের অসংখ্য বোয়াল মাছ। দামেও কম। এক কেজি বোয়াল মাছ বিক্রি হচ্ছে আড়াইশত থেকে চারশত টাকা কেজি দরে। তবে বড়গুলোর দাম আরো বেশী। সুযোগ বুঝে সকল শ্রেণী পেশার মানুষই এবছর বোয়াল মাছ খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রবীনরা জানিয়েছেন, মেঘনা, আড়িয়ালখা, হাড়িধোয়া, শীতলক্ষা ইত্যাদি নদ-নদীসহ খাল-বিল, হাওড় বাওড়ে যেসব বড় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে বোয়াল বিশেষ প্রকৃতির মাছ। মেঘনা এবং বিল ঝিলই হচ্ছে বোয়াল মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। এই বোয়াল মাছকে বলা হয় স্বাদু পানির হাঙ্গর। রাক্ষুসে চরিত্রের কারণে বোয়াল মাছের এই নামকরণ। গুড়া মাছের যম বোয়াল মাছ বিশাল হা করে শত শত গুড়ামাছকে গলাধ:করণ করে থাকে। বোয়াল মাছ নিয়ে দেশের গ্রাম গ্রামান্তরে রয়েছে নানারকম মুখরোচক গল্প। বোয়াল মাছ সকল প্রকার গুড়া মাছ, মাঝারি আকারের মাছ, ব্যাঙ, ছোট সাপ, ইঁদুর, গন্ধমুষিক (চিকা), ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে। বোয়াল মাছের রাক্ষুসে চরিত্রকে প্রতীকি করে বড় বড় দুর্নীতিবাজ মানুষদেরকে ‘রাঘব বোয়াল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। মাছ শিকারীরা জানিয়েছে, শীতকালে বোয়াল মাছ নদীর পানির কিনারে গিয়ে লেজটি চিকার গর্তে ঢুকিয়ে বসে থাকে। গর্তে থাকা চিকা যখন মাছের গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে এসে বোয়ালের লেজে কামড় দেয় তখনই বোয়াল তার লেজ দিয়ে ঝাটকা মেরে চিকাটিকে পানিতে ফেলে দিয়ে গিলে ফেলে। বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি হলে বোয়াল মাছ নদ-নদী থেকে ঢলের পানিতে উজানে উঠে খাল-বিল, পুকুর, নালা, হাওড়-বাওড়ে ঠাই নেয়। গ্রামের মানুষ এ সময় বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে এসব বোয়াল শিকার করে। আবার মাঘ ফাল্গুন মাসে নদ-নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি কমে গেলে গ্রামের মানুষ দল বেধে পলোয়া দিয়ে বোয়াল মাছ শিকার করে। বাংলাদেশে কৃত্রিম মৎস্য চাষ শুরু হবার পর থেকে বোয়াল মাছের সংখ্যা কমতে থাকে। আশির দশকের পর থেকে বোয়াল মাছের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যায়। নরসিংদীসহ দেশের বাজারগুলো বোয়াল মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। কদাচিৎ দু/একটি বোয়াল বাজারে উঠলে কয়েক হাজার টাকায় কিনে নিয়ে যায় সমাজের ভাগ্যবান ব্যক্তিরা। সাধারণ মানুষের ভাগ্যে বোয়াল মাছ জুটতো না। বৃষ্টি হলে নদ নদী থেকে খালের পানি দিয়ে বড় বড় বোয়াল মাছ উঠে যেতো পাটক্ষেতে। আবার রাতে পানি কমে গেলে শুকনায় আটকা পড়ে ধরা পড়তো বড় বড় বোয়াল। মাছের বাধে চাইয়ের ভিতর গিয়ে আটকা পড়তো বড় বড় বোয়াল।

 



 

Show all comments
  • মোঃ মোতাহের হোসেন ১৮ নভেম্বর, ২০১৭, ২:২০ এএম says : 0
    বোয়াল মাছ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সস্তির সংবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ