ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মানুষের জীবন বাঁচায় যে খাদ্যদ্রব্য তা যদি আকাশছোঁয়া চড়া দামে কিনতে হয় আর দুঃখের সীমা থাকে না। প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর কারণে প্রভাবটা সরাসরি পরিবারের ব্যয়ের উপর পড়ছে। আর এ কারণে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটে তখন সেখানে অপরাধীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই পারে অপরাধীর বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে। যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারাই বলেন জনগণের ভাগ্যের পরির্বতনের জন্য রাজনীতি করেন। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কারণ যারাই ক্ষমতার গদিতে বসেন তারাই হিটলার-মুসলিনির উত্তরসূরীর ভূমিকা পালন করেন। জনগণের কল্যাণে যদি রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন তাহলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এতো বেড়ে যেতো না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাকিতে কেনাকাটা বাড়ছে পাড়া বা মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে। ডিপার্টমেন্ট স্টোরেও ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা বেড়েছে। স্বল্প আয় দিয়ে কোনো রকমে মাস পার করতে পারলেও এ থেকে সঞ্চয় করার সুযোগ পাচ্ছে না কেউ। খরচের চাপে যে বেসামাল নি¤œ আয়ের মানুষ, এটা শহরের পাড়া বা মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে কথা বললে যে কেউ বুঝতে পারবে। ব্যয়ের চাপ সামলাতে না পেরে অনেকে ব্যাংক থেকে ডিপিএস ভাঙাচ্ছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডিপিএসসহ অন্যান্য মেয়াদি আমানত আগের মত আর বাড়ছে না। বাংলাদেশে ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, গত আগস্ট মাস শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে মেয়াদি আমানতের স্থিতি ছিল সাত লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এর পরিমাণ ছিল সাত লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানত বেড়েছে মাত্র ৮.৭৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের আগস্টে এর হার ছিল ১২.০৮ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেয়াদি আমানত বৃদ্ধির হার কীভাবে কমেছে।
দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস মানুষ ফেলতে পারছে না। একদিকে গুম, খুন, অপহরণের বিভীষিকা অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা মানুষকে কষ্টের ফ্রেমে বন্দি করে দিচ্ছে। দেশের সরকার যখন শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ফন্দি করে তখন আর কোথাও কোনো ভারসাম্য না। সরকার ক্ষমতায় এসেই সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ করে দিয়েছে। এটা দোষের, তা আমি বলছি না। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে কর্মরতদের জন্যও একটা বেতন কাঠামো দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করা। একটা সময় মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিটা নিতে পারলে জীবনে আর কিছু লাগে না। এমনিতেই গাড়ি বাড়ি সব হয়ে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতনবৈষম্য না থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতনবৈষ্যমও আকাশ-জমিন। দেশের স্বনামধন্য কিছু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে আমার পরিচিতি কিছু লোক চাকরি করেন। তাদের নিকট থেকে জানতে পারলাম তারা বেতন বৈষ্যমের শিকার। একজন তো বলেই ফেলল যে কোম্পানির এমডি, জিএম, ম্যানেজারদের বেতন আর সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের ব্যবধান আকাশ-পাতাল তফাত। এই দেশে যদি ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে একজন পিয়ন কিংবা ক্লিনারের বেতন আর রাষ্ট্রপ্রধানের বেতনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান হতো না। এই বৈষম্য দূর করা তো সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার তা করছে না। এই সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র আইন করে সম্ভব নয়। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল নাগরিক তার সুফল ভোগ করতে পারবে। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গত মার্চে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকার শীর্ষের এখন ঢাকা। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১০ সালে দেশের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। বিপরীতে খরচ ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। ফলে প্রতি মাসে সাশ্রয় করতে পারতো ২৭৯ টাকা। ২০১৬ সালে একটি পরিবার সাশ্রয় করতে পারতো ২৩০ টাকা। আলোচ্য বছর একটি পরিবারের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা এবং ব্যয় ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশর ক্যাব-এর ভাষ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ক্যাব বলেছে, রাজধানীতে ২০০৯ সালের দুই শয়নকক্ষ বা বেডরুমের একটি পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা, ২০১৬ সালে তা ১৯ হাজার ৭০০ টাকা উঠেছে।
সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে হিসাবটা কোনভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। নিম্নবিত্তের জন্য এক একটা দিন পার করাটা কত যে কষ্টের তা কেবল মাত্র ভুক্তভোগী পরিবারই অনুধাবন করতে পারে। মধ্যবিত্তের দিনও যেন আর চলে না। দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। তবু সবজির বাজারে আগুন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, গত তিন মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দ্বিগুণ। বাজার ভেদে পণ্যের দাম বাড়ার হার আরো বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাজারে সিটি কর্পোরেশনের মূল্যতালিকা থাকলেও তা হালনাগাদ কিংবা তদারকি করা হয় না। রাজধানীর বাজারগুলোতেও নেই কোন তদারকি। আর সে সুযোগে ইচ্ছেমত দাম হাঁকায় একশ্রেণীর অসাধু বিক্রেতা। বাজারে এখন সবচেয়ে কম দামি সবজির দাম ৬০ টাকা। কেন বাড়ছে শাকসবজির দাম। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোরই। তবে শাকসবজির দাম বাড়ার অজুহাতের অভাব নেই বিক্রেতাদের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষ্যমতে, এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৮৭ যা গত বছর একই সময়ে ছিলো ৫ দশমিক ১০। শুধুমাত্র গত তিন মাসেই মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ হয়েছে। গত এক বছরে গ্যাসের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। এ অবস্থায় নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তদের মধ্যেও হতাশা বাড়ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে প্রতিদিনের বাজার তালিকা। ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে জীবন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, লবণ, তেল, পিয়াঁজ কাঁচামরিচ সব পণ্যেই আগুন লেগেছে। আর কাঁচাবাজারের তাপে পুড়ে যাচ্ছে হাত। শিক্ষার ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নানা ছুঁতোয় বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে বাড়িওয়ালা। দিন যেন চলতে চায় না। তারপরও দিন চালাতে হয়। চলছে। চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে চেপে সংসার নামক ঘানিকে টেনে নিচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্তরা। তাদের জীবনে নেই কোনো আশা-আকাঙ্খা, নেই কোন উচ্চাবিলাস। তারপরও তাদের উপরই খড়গ চলছে। আমরা আশা করি, সরকার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের কথা বিবেচনা করে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।