Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মামলা করার সাহস পান না ভুক্তভোগীরা

চট্টগ্রামে চলছে নীরব চাঁদাবাজি

| প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রী নিয়ে সিমেন্ট ক্রসিং এসেই থেমে যায় টেম্পু। সেখানে পুলিশ বক্সের উল্টোদিকে দাঁড়ানো এক যুবক এগিয়ে আসতেই তার হাতে টাকা গুঁজে দেন টেম্পু চালক। ওই যুবক টাকা গুণে নিয়ে টেম্পু নাম্বারটি লিখে রাখে। টেম্পু ছুটতে থাকে গন্তব্য ইপিজেডের দিকে। গতকাল (শুক্রবার) দুপুর ১২টায় চাঁদা নেয়ার এ ঘটনা ঘটে পুলিশ সদস্যদের সামনে। এমন দৃশ্য দেখা যায় প্রতিদিন। টেম্পু চালক জসিম উদ্দিন বলেন, পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের জন্যই এ চাঁদা দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন প্রতিটি টেম্পু চালক ৬০ টাকা করে চাঁদা দেয়। পুলিশ বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের সোর্স চালকদের কাছ থেকে এ চাঁদার টাকা তোলেন। পরে অবশ্য পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তাদের জন্য চাঁদা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। যে চাঁদা নিয়েছে তাকে চিনেন না বলেও জানান তারা।
টেম্পু চালক জানান, বিমানবন্দর থেকে ইপিজেড রুটে আড়াইশ থেকে তিনশ টেম্পু চলাচল করে। সব চালককে দৈনিক চাঁদা গুনতে হয়। কাটগড় থেকে ইপিজেড এবং বিমানবন্দর পর্যন্ত চলাচলকারী প্রায় এক হাজার টমটম চালকদেরও প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। নগরীর অন্য এলাকায়ও একই চিত্র। চালকরা বলেন, টাকা না দিলে পুলিশ রাস্তায় গাড়ি চলতে দেবে না। মাস্তানরাও হয়রানি করবে। সুতরাং চাঁদা দিলেই নিরাপদ। কুমিল্লা ও সীতাকুÐ থেকে সবজি কিনে ট্রাকবোঝাই করে চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজার ও স্টিল মিল বাজারে আনেন ব্যবসায়ী আবদুর রহিম। তিনি বলেন, সবজিবোঝাই ট্রাক আনার পথে মহাসড়ক এবং চট্টগ্রাম নগরীর কয়েকটি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। ট্রাক পার্কিংয়ের জন্যও বখশিশ দিতে হয়। হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি মাস্তানরাও চাঁদার জন্য ট্রাক থামায়। চাঁদা না দিলে ঝামেলা হবে। এ ভয়ে নিয়মিত তিনি তাদের দাবি পূরণ করেন। চাঁদা বাবদ যে টাকা দিতে হয় তা আদায় করেন সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়ে। তার সাফ কথা চাঁদা না দিয়ে ঝামেলায় গিয়ে লাভ কী।
এভাবে নিরবে চাঁদাবাজি চলছে চট্টগ্রামে। পেশাদার চাঁদাবাজ, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, মাস্তান, সন্ত্রাসী, পুলিশ, বিভিন্ন পরিবহন সংগঠনের নেতারা বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। ফুটপাতের ভাসমান দোকানদার, পাড়া-মহল্লার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্পপতি ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। বিদেশে পলাতক মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী, কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চলছে চাঁদাবাজি। জান-মালের নিরাপত্তায় চাঁদাবাজদের দাবি নিরবেই পূরণ করছেন ভুক্তভোগীরা। চাঁদাবাজির ঘটনা থানা-পুলিশকে জানালে প্রাণ যাবে এমন হুমকিও আসে চাঁদাবাজদের কাছ থেকে। আর এ কারণে চাঁদা দিয়েও নিরব থাকেন ভুক্তভোগীরা। পুলিশের খাতায় এসব ঘটনা রেকর্ড হয়না। কারণ কেউ মামলা করেন না। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইটে মাসিক অপরাধের খতিয়ান দেয়া হয়েছে। তাতে চাঁদাবাজির যে কলামটি আছে তা বরাবরই ফাঁকা থাকছে। আর এ কারণে নগর পুলিশের কর্মকর্তারা দাবি করেন, চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি নেই। সিএমপির একজন কর্মকর্তা জানান, চাঁদাবাজির খবর আমরাও পাই। তবে কেউ মামলা করতে আসে না। পুলিশের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে থানায় জানাতে বলা হয়েছে। চাঁদাবাজদের ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলেও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিরবে চাঁদাবাজদের দাবি পূরণ করতে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ সরব হয়ে উঠেন দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ীরা। চাঁদা না দেয়ায় সন্ত্রাসীদের একের পর এক হামলার শিকার হন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ থেকে পাইকারি দরে পণ্য কিনতে আসা ব্যবসায়ী ও ট্রাক চালকেরাও তাদের রোষানলে পড়েন। ব্যবসায়ীদের উপর হামলার পাশাপাশি টাকা-পয়সা কেড়ে নিতে শুরু করেন চাঁদাবাজরা। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমী এক কর্মসূচিতে নামেন। নিজেদের পয়সায় সন্ত্রাসীদের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে তা এলাকায় লাগিয়ে দেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবিতে প্রচারপত্রও বিলি করেন। ‘সন্ত্রাসী লিডার সুজন’, ‘সন্ত্রাসী লিডার মামুন’, ‘সন্ত্রাসী ব্যাঙ সোহেল’, ‘ইয়াবা সাফায়েত ফাহিম’, ‘ইয়াবা আমিন ওরফে মুছা’, ‘সন্ত্রাসী জনি সরকার’ এবং ‘ইয়াবা রাজীব’ নামের এ সাত সন্ত্রাসীর ছবি দিয়ে লাগানো হয় পোস্টার। পোস্টারের ওপরের অংশে লেখা, এদের ধরিয়ে দিন।
চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীদের চারটি সংগঠনের উদ্যোগে এসব পোস্টার লাগানো হয়। সংগঠনগুলো হলো চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতি, চট্টগ্রাম চাউল ব্যবসায়ী সমিতি, চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতি ও চট্টগ্রাম চট ব্যবসায়ী সমিতি। এই চার সংগঠনের উদ্যোগে সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে এলাকায় প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। নিরীহ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, বাসাবাড়িতে ডাকাতি, ট্রাকচালকদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল সেট ছিনতাইসহ নয় সন্ত্রাসীর নানা অপকর্মের তথ্য পোস্টার ও প্রচারপত্রে উল্লেখ করেন ব্যবসায়ী নেতারা। চাক্তাই এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণের নামে ছাপানো পোস্টারে এই সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র বাকলিয়া থানা এবং চাক্তাই পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেওয়ারও অনুরোধ করা হয়। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। চাঁদাবাজরা কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।
ব্যবসায়ীরা জানান, চালের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চাক্তাই। এই বাজারে আছে চালকলও। চাল ছাড়াও নানা ভোগ্যপণ্য এই বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০ কোটি টাকা বেচাকেনা চলে এই বাজারে। দীর্ঘদিন থেকে ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি। শুরুতে ব্যবসায়ীরা নিরবেই চাঁদা দিতেন। কিন্তু দিনে দিনে চাঁদাবাজদের তাÐব বাড়তে থাকে। তারা রাতে মোটরসাইকেলে এসে মহড়া দেয়। এরপর সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীদের মারধর করে চাঁদা আদায় করে। দূরদূরান্ত থেকে আসা ট্রাকচালকেরাও তাদের কাছ থেকে রেহাই পান না। চাঁদা না দেয়ায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে মারধর করে তারা। অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সরব হন।
নগরীতে গড়েউঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান টেম্পু। নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন টেম্পুর বিরুদ্ধে নগরীর পাঁচলাইশ, বায়েজিদ ও চান্দগাঁও থানায় ২৪টি মামলা আছে। টেম্পু চান্দগাঁও থানার তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী হলেও নগরীর ব্যবসায়ীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। চান্দগাঁও পাঁচলাইশসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় তার বাহিনীর সদস্যরা দীর্ঘদিন থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে আসছে। ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল নগরীর চাঁন্দগাও থানার শমসেরপাড়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন টেম্পু। দেড় বছর কারাগারে থাকার পর গত ডিসেম্বরে টেম্পু জামিনে মুক্তি পায়। এরপর চান্দগাঁও থেকে বায়েজিদে গিয়ে আস্তানা গড়ে বিশালবাহিনী সৃষ্টি করে টেম্পু। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় হচ্ছে ওই বাহিনীর মূল পেশা।
টেম্পু বাহিনীর মত নগরীতে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত আরও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা। নিরবে চাঁদা দাবি করে না পেলে অনেক সময় অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। এজন্য দলের নাম ব্যবহার করা হয়। আবার নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজরা। গত এক বছরে নগরীর বায়েজিদ, শেরশাহ কলোনি, পলিটেকনিক, নাসিরাবাদ, চমেক হাসপাতাল এলাকা, জিইসি মোড় এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। তিনি বলেন, অনেকে ভয়ে মামলা করতে চান না। ব্যবসায়ীদের এ ভয় দূর করতে কমিউনিটি পুলিশ কাজ করছে। চাক্তাই এলাকায় ব্যবসায়ীদের পোস্টার লাগানোর পর অভিযুক্ত ৫ চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ওই এলাকায় চাঁদাবাজি নেই। অন্য কোন এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ