Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিসংখ্যান সঠিক ও বিশ্বমানের হওয়া আবশ্যক

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কোন বিষয়ে সংখ্যা ও মান সঠিক না হলে সে বিষয়ে পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যায়। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি গুরুত্বহীন থেকে যায়। ফলে যা হবার তাই হয়। চরম বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কর্ম বাস্তবায়নও ঠিকমত হয় না। যেমন: সরকারিভাবে বলা হচ্ছে বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩%। কিন্তু বেসরকারিভাবে বলা হচ্ছে ৫১.২%। সাক্ষরতার মান নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এ বছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, বিবিএসের ২০১৬ সালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। বর্তমান সরকারের নানামুখী কর্মসূচির কারণে আগের তুলনায় সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখনো প্রায় ২৭.৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। তাদের সাক্ষর করতে না পারলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশ নিরক্ষরমুক্ত হবে। অপরদিকে, ইউনেস্কোর মতে, সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৬১.৫%। ক্যাম্পের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৫১.৩%। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ক্যাম্পের এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সে মতে, দেশে সাক্ষরতার হার পুরুষের ৫০.৫%, নারীর ৫৩.২% ও অন্য জেন্ডারের ৪০.১%। অর্থাৎ ব্যাপক গড়মিল রয়েছে। অবশ্য মন্ত্রীর মন্তব্য মনগড়া। কারণ, ২০১১ সালের পর এ ব্যাপারে বিবিএসের কোনো জরিপ হয়নি। তবুও মন্ত্রী ‘বিভিন্ন অগ্রগতির কারণে’ উক্ত হারের কথা উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন, সরকারি প্রচেষ্টার কারণে দেশের সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জানা গেছে, গত তিন বছর সরকারিভাবে সাক্ষরতা কর্মসূচি স্থগিত ছিল। তবুও এই সময়ে সাক্ষরতার হার ১১% বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, মনগড়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে কি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা যায়? যায় না।
দেশের সাক্ষরতার মান নিয়েও পার্থক্য আছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রীর অভিমত হচ্ছে, ‘সাক্ষরতা মানে শুধু লিখতে, পড়তে পারলেই হবে না। আমরা সাক্ষরতা বলতে বুঝি যিনি লিখতে পারেন, পড়তে পারেন, শব্দ গঠন করতে পারেন, খবরের কাগজ পড়তে পারেন।’ অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুযায়ী, সাক্ষরতা হচ্ছে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে ও লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। এটি একটি ধারাবাহিক শিখন-প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজস্ব বলয় এবং বৃহত্তর সমাজের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের ক্ষমতা ও জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়। তাই সাক্ষরতার মানদন্ড হিসেবে যেন ‘অন্তত তৃতীয় শ্রেণি’ পাস করা শিক্ষার্থীর সমমানের হওয়াকে বিশেষজ্ঞরা নির্ধারণ করেছেন। আর তত্বাবধায় সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর অভিমত হচ্ছে, ‘বিবিএস কোন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে জরিপ করেছে, সেটা আমার জানা নেই। তবে আমরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে জরিপটি করেছি। আমার মনে হয়, মূলত সংজ্ঞাগত কারণেই হার নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জরিপ করার সময় লিখতে, পড়তে, বলতে ও বুঝতে পারে কি না, সেটা দেখেছি। একই সঙ্গে প্রায়োগিক দক্ষতাও দেখা হয়েছে।’ অন্য এক তথ্য মতে, সাক্ষরতার হার নিয়ে বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। ঐ জরিপের তথ্যানুযায়ী তখন সাক্ষরতার হার ছিল ৫৮.০৮%। এরপর বিবিএসের এমএসভিএসবি প্রকল্পের অধীনে প্রতিবছর দেশের জনসংখ্যার পরিস্থিতি হিসাব করা হয়। ২০১৬ সালের শুরুতে ওই কাজের অতিরিক্ত হিসেবে সাক্ষরতা পরিস্থিতি দেখা হয়। তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তারা চিঠি লিখতে পারে কি না। ওই প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ জবাবের ওপর ভিত্তি করে সাক্ষর মানুষ হিসাব করা হয়েছে। কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। সেই হিসাবেই সরকার এখন বলছে, দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩%। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নকমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদের মতে, ‘শুধু স্বাক্ষর করতে পারলেই সে সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হবে, তা নয়। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। গতানুগতিক প্রকল্প দিয়ে সাক্ষরতার হার সেভাবে বাড়ানো যাবে না। এ জন্য নাগরিক আন্দোলন এবং সরকারের কমিটমেন্ট দরকার।’ এছাড়া আরো কিছু বিশেষজ্ঞের অভিমত হচ্ছে, নানা প্রণোদনা দিয়ে কিছু মানুষকে সাক্ষর করা হয়। কিন্তু প্রণোদনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা আর সেটার চর্চা করে না। ফলে ভুলে গিয়ে যাহা পূর্বং তাহা পরং-ই হয়। মোটকথা দেশের সাক্ষরতার হার ও মান নিয়ে মহা হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে।
সাক্ষরতার ন্যায় অন্যসব শিক্ষার হার ও মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। এ জন্য সরকার গর্ববোধ করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পরীক্ষা পদ্ধতি সহজতর করার কারণেই হার, জিপিএ-৫ ও গোল্ডেন পাওয়ার হিড়িক পড়েছে আর শিক্ষার মানে ধস নেমেছে। ফলে এসব নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে ২০১৭ সালের এসএসসি পরীক্ষা কিছুটা কঠিন করার ফলে ফল বিপর্যয় ঘটে ব্যাপক। তাই বহু কলেজ ভর্তি করার জন্য শিক্ষার্থী পায়নি। এই অবস্থায় দেশের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের করা হলে শিক্ষার হার যা আছে, তার অর্ধেকে নেমে আসবে তা নিশ্চিত।
দেশের দারিদ্র্যের হার ও নির্ণয় পদ্ধতি নিয়েও ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে। বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬-এর তথ্য মতে, দেশে গত ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার ৭.২% কমেছে। তবে বেড়েছে আয় বৈষম্য। দারিদ্র্য হার বর্তমানে ২৪.৩% ও অতি দরিদ্রের হার ১২.৯%। অন্যদিকে, গত কয়েক বছরে দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য অনেক বেড়েছে। ধনিক শ্রেণির আয় যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি গরিবের আয়। দেশের মোট আয়ের ২৮% রয়েছে ৫% ধনাঢ্য পরিবারের হাতে। আর সবচেয়ে গরিব ৫% পরিবারের আয় মাত্র দশমিক ২৩%। অর্থাৎ ২০০৫ সালের জরিপে দেশে যে আয়বৈষম্য ছিল, ২০১০ সালে জরিপে তা কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের জরিপে তার অবনতি হয়েছে। এ জরিপকালে দৈনিক খাদ্য গ্রহণের ভিত্তিতে দারিদ্র্য হার নিরূপণ করা হয়েছে। এতে ১১টি খাদ্য উপাদানের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে জনপ্রতি প্রতিদিন ২১২২ কিলো ক্যালরি গ্রহণ করতে না পারলে তাদের দরিদ্র গণ্য করা হয়েছে। সে মতে, মোট খাদ্য গ্রহণের হার পূর্বের তুলনায় কমেছে। ২০১০ সালে দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ছিল গড়ে এক হাজার গ্রাম, যা ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৯৭৬ গ্রাম। প্রতিবেদন অনুযায়ী চাল ও আটা গ্রহণের হার কিছুটা কমেছে। আর ডাল, শাক-সবজি, মাংস ও ডিম খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালে দৈনিক ২৩১৮ কিলো ক্যালরি গ্রহণ করা হলেও ২০১৬ সালে গ্রহণ করা হচ্ছে ২২১০ কিলো ক্যালরি। প্রোটিন গ্রহণের হার ২০১০ সালে ছিল ৬৬.২৬ গ্রাম এবং ২০১৬ সালে হয়েছে ৬৩.৮০ গ্রাম। ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী তসলিম আয়বৈষম্যের এ পরিস্থিতিকে দেশের জন্য উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। আর বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, এ জরিপে ভালো খবর হচ্ছে দারিদ্র্য কমেছে। আর মন্দ খবর হচ্ছে, দারিদ্র্য কমার গতি কমে গেছে। বিশ্বব্যাংকের সূত্র মতে, মাথাপিছু দৈনিক গড় আয় ১.৯০ ডলারের নীচে হলে দরিদ্র, ১.৯০ ডলার হলে নি¤œবিত্ত, ২-৩ ডলার হলে মধ্যবিত্ত আর ৩-৪ ডলার হলে উচ্চবিত্ত। এই সূত্র মতে, দেশের দারিদ্র্য নির্ণয় করা হলে হার বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।
দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে সা¤প্রতিককালে অনেক নাটক রচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। অথচ খাদ্য মজুদের সঠিক তথ্য প্রকাশিত হলে এবং সে মোতাবেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে খাদ্যমূল্য আকাশচুম্বি হয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেত না। এফএওর বৈশ্বিকখাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, ‘২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম আমদানি করবে’। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা বর্তমানে ১৭ লাখ টন। আর গুদামে বর্তমানে চাল মজুদ আছে মাত্র ৩.৬৬ লাখ টন। আপদকালীন মজুত ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো চালিয়ে নিতে সরকারি গুদামে ৮-১০ লাখ টন চাল থাকা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সিপিডির এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, এবার বন্যায় ফসলহানির পরিমাণ ৩০%, যার মূল্য ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ইতোপূর্বে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, বন্যায় ফসলহানির পরিমাণ ২০ লাখ মেট্রিকটন। অর্থাৎ ফসলহানি নিয়ে মতপার্থক্য আকাশ পাতাল। তেমনি অবস্থা খাদ্য মজুদ নিয়েও। আপদকাল মোকাবেলার জন্য যা প্রয়োজন, তার এক তৃতীয়াংশও নেই। ফলে খাদ্যের মূল্য আরো বাড়তে পারে! কারণ, আগামী আমন ধান মওসুমে তেমন ধান পাওয়া যাবে না। বোরা-ইরি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই দ্রæত গতিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করে ন্যায্যমূল্যে বাজারজাত করা আবশ্যক।
একই অবস্থা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে। তাই সঠিক পরিকল্পনার জন্য দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংখ্যা ও মান বিশ্বমানের হওয়া আবশ্যক। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, আমার এক বন্ধু সরকারি এক অফিসে চাকরি করতেন। তিনি ৪-৫ বছর আগে অবসরে গেছেন। অথচ তার বড়ভাই এখনো চাকরিতে বহাল আছেন এবং একই অফিসে। এর কারণ হচ্ছে, স্কুলের কেরানি সাহেব ইচ্ছেমত বয়স নির্ধারণ করেছেন। ফলে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়ে তিনি এখন খুব কষ্টে আছেন। অথচ বয়স সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হলে তিনি এখনো চাকরিতে থাকতেন এবং নতুন পে স্কেলে বেতন দ্বিগুণ হয়ে ভালভাবেই জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি জন্ম তারিখ সঠিকভাবে নির্ধারণ না করার জন্য। একই অবস্থা আমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রেই ঘটছে। ফলে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন