ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘটনাটি এইরূপ বর্ণিত হয়েছে: ভারতবর্ষে ফার্সি ভাষায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ কর্তৃক সর্বপ্রথম কোরআনের তর্জমা প্রকাশিত হওয়ার পর দারুণ চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কিছু লোক মনে করতে থাকে যে, তাদের রুজি-রোজগারের ইমারত চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এখন জাহেল মূর্খরা কাবুতে (নিয়ন্ত্রণ) থাকবে না এবং প্রত্যেক বিষয়ে বাহাস-বিতর্কে জড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া শাহ সাহেবের প্রতি কোফরের ফতোয়া জারি করার ব্যাপারে তারা ঘোর শত্রুতা শুরু করে দেয়। তাকে হত্যা করার জন্য বদ্ধমূল হয়ে পড়ে। তাদের ইঙ্গিতে কতিপয় বদমাশ শাহ সাহেবের প্রতিক্ষায় ওত পেতে থাকে। অথচ এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিল না। একদিন তিনি ফতেহপুরী মসজিদে আসরের নামাজ আদায়রত অবস্থায় সালাম ফেরাচ্ছিলেন, এমন সময় মসজিদের প্রবেশ পথে হৈ চৈ (শোরগোলের) শব্দ শোনা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গুন্ডাদের একটি দল শাহ সাহেবের ওপর হামলা করতে উদ্যত হয়েছে। তখন শাহ সাহেবের সঙ্গে কয়েকজন খাদেম ছিল, অপরদিকে হামলাকারীদের সংখ্যা ছিল বিপুল। শাহ সাহেব চাইছিলেন খারি বাউলি দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবেন। কিন্তু হামলাকারীরা সেদিকে এসে তা ঘিরে ফেলে। শাহ সাহেবের নিকট একখানা ছুরা ছিল। তিনি হামলাকারীদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাও কেন? তারা জবাবে বলল, আপনি কোরআনের অনুবাদ করে জনগণের দৃষ্টিতে আমাদের গুরুত্ব মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামান্যতম গুরুত্বও অবশিষ্ট থাকবে না। আপনি কেবল আমাদেরকেই বরবাদ করেননি, আমাদের সন্তানাদিকেও ধ্বংস করেছেন। তাদের বক্তব্য শোনার পর শাহ সাহেব বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব যে, আল্লাহর প্রদত্ত সাধারণ নেয়ামত কয়েক ব্যক্তি বা তাদের সন্তানদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে! কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হতে থাকে। ওরা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বেই শাহ সাহেবের খাদেমগণ তরবারি উচিয়ে ধরেন এবং গুন্ডাদল তরবারি দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় শাহ সাহেব নিরাপদে তার বাসভবনে ফিরে যান।
হায়াতে ওয়ালির লেখক মির্জা হযরত দেহলভী বর্ণিত এ ঘটনাকে হযরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ একটি গল্প বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি সত্যিকারের বাস্তব ঘটনাটি নিন্মরূপে বর্ণনা করেছেন।
প্রকৃত ঘটনা এটাই মনে হয় যে, শিয়া শাসকবর্গ একথা পছন্দ করতেন না যে, জনসাধারণ কোরআন সম্পর্কে অবহিত হোক। বর্ণিত আছে যে, দিল্লীতে নজম আলী খানের কর্তৃত্ব ছিল। সে শাহ ওয়ালিউল্লাহর হাতের কব্জি ভেঙ্গে তা বেকার করে দিয়েছিল যাতে তিনি কোনো কিতাব অথবা রচনা লিখতে না পারেন।
দিল্লীর শিয়া শাসক নজম আলী খান কর্তৃক শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)’র হাতের কব্জি ভেঙ্গে দেয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, সেকালের শিয়া শাসক কত বড় শাহ সাহেব বিদ্বেষী ছিল। তিনি এ ভাঙ্গা হাতে দুই শতাধিক পুস্তক রচনা করে যে অভূতপূর্ব বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছেন তা মুসলিম ভারতের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কোরআনের অনুবাদ করলে স্বার্থপর উলামাদের ভাগ্য বিড়ম্বনা হবে- এই অজুহাতে তার ওপর এবং তার দুই সুযোগ্য সন্তানের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল তা ইতিহাসের এক কলংকজনক অধ্যায়। শাহ আব্দুল আযীয ও শাহ রফিউদ্দীনকে দেশান্তর করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)’র পরবর্তী তার মহান পুত্রগণ কোরআন ও হাদীসের শিক্ষা সমগ্র উপমহাদেশে যে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন তা আরেকটি গৌরবময় অধ্যায়। বিশেষভাবে কোরআনের তরজমা ও তফসির রচনার ক্ষেত্রে তাদের অবিস্মরণীয় অবদান মুসলিম উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। শাহ সাহেবের জৈষ্ঠ্য পুত্র হজরত শাহ আবদুল আযীয (রহ.)’র রচনাবলীর মধ্যে তফসিরে হোসাইনী সুবিখ্যাত। এ তফসিরের লেখক হিসেবে শাহ আব্দুল আযীয (রহ.) বা অন্য কারো নাম উল্লেখ না করেই ড. মওলভী আবদুল হক বোবায়ে উর্দূ নামে খ্যাত তার এক প্রবন্ধে তফসিরে হোসাইনীর তরজমা সম্পর্কে যে পরিচয় তুলে ধরেছেন তার মর্ম এইরূপ:
তফসিরে হোসাইনীর অনুবাদও কোনো একজন পুরোনো দাকিটি (দাক্ষিণাত্যের) ভাষায় করেছেন। এ তফসির অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তার বিভিন্ন তরজমা দাক্ষিণাত্যের ভাষায় হয়েছে। এ সময় আমার সামনে আম পারার তফসিরের অনুবাদ রয়েছে। তার ভাষা পুরোনো এবং শেষদিকে লেখক দিন, সময় এবং তারিখ জুমাবার, সময় আসর ও মাস জমাদিউল ওখরা লিখেছেন। কিন্তু সন লেখেননি।
তফসিরে হোসাইনীর নাম- বরাত খুব বেশি দেখা না গেলেও কোনো কোনো তফসিরে কিংবা তরজমায় তফসিরে হোসাইনীর বরাত (হাশিয়ায়) পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত কাজী মোহাম্মদ মাজহারীতে তফসিরে হোসাইনী বহুক্ষেত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। তবে একই নামে মোল্লা কামাল উদ্দীন হোসাইন ওয়ায়েজ কাশফী আল হারবী (৯০০ হি.) কৃত তফসিরটির উর্দূ অনুবাদ করেছেন আবদুর রহমান বোখারী, এটির নাম তফসির মাঈদী। শাহ আবদুল কাদের (রহ.) কৃত মোযেহুল কোরআন এবং শাহ রফিউদ্দীন (রহ.) এর তরজমা খুবই প্রসিদ্ধ। তাই এদুইটি তরজমার বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। মোটকথা, শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) এবং তার খান্দানের কোরআন প্রচারে যে অনন্য ভূমিকা রয়েছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। হাদীস ও ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও দিকের ওপর শাহ সাহেবের রচনাবলীর সূচি প্রস্তুত করতে গেলেও স্বতন্ত্র গ্রন্থ হয়ে যাবে।
হরজত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)’র জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা করতে হলে বিশাল পরিসর প্রয়োজন, যা এখানে সম্ভব নয়। কোরআন শরীফের ফার্সি অনুবাদ করে তিনি সে সঙ্গীন পরিস্তিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তার কিছুটা বিবরণ উপরে দেয়া হয়েছে। তিনি একজন মোহাদ্দেস ও মোফাসসির হিসেবে উপমহাদেশে সুখ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন তা সংক্ষেপে এইভাবে ব্যক্ত করা যায় যে, ইসলামী শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে উপমহাদেশকে যে ক’ভাগে ভাগ করা যায় শাহ সাহেব হতে তার একটি সূচিত হয়েছে। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানির পর শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)’র কর্মধারার অনুসরণে এ উপমহাদেশে সংস্কার ও স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহর আদর্শনীতির অনুসরণ করেই স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং আত্মত্যাগে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। শাহ সাহেব ও তার খান্দানের ভূমিকা বাদ দিয়ে উপমহাদেশে স্বাধীনতার ইতিহাস কল্পনাও করা যায় না।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)’র উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অনেকের অনুকরণীয় গুরুত্বপূর্ণ অভিমত রয়েছে। শাহ সাহেবের সংস্কার মূলক কীর্তিমালার তালিকা ও সুদীর্ঘ এবং বিখ্যাত উলামায়ে কেরাম তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ মিসরের বিখ্যাত সমালোচক আল্লামা রশিদ রেজার নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মিফতাহু কুনুর্জি নামক গ্রন্থের ভূমিকায় হজরত শাহ সাহেবের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন, যদি আমাদের হিন্দুস্তানী উলামা ভ্রাতাগণের দৃষ্টি সেকালে উলুমে হাদীসের প্রতি আকৃষ্ট না হতো তাহলে এ শাস্ত্রের অবনতি ও বিলীন হওয়ার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেই গিয়েছিল।
শাহ সাহেবের সংস্কারমূলক কীর্তিসমূহের মধ্যে প্রধান দুটি হচ্ছে, সে যুগে প্রচলিত ইসলামী শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন ও নতুন রীতিতে শিক্ষা দান এবং প্রচলিত ভাষায় কোরআন ও হাদীসের অনুবাদ করা। অতঃপর ধর্মীয় সম্প্র্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা। এসময় তিনি পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে জেহাদের চিন্তা বাদ দেন এবং সমাজের মন-মানসিকতা ও চিন্তা ইসলামী চিন্তা ধারায় গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যাতে তার মিশন অনুযায়ী একটি বিপ্লব সৃষ্টি হয়। তার যোগ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত একদল শিষ্য তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে চিন্তা জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করেন। তার উত্তরসূরীদের মধ্যে ছিলেন তার সুযোগ্য পুত্রগণ এবং শাহ ইসমাইল শহীদ ও সৈয়দ আহমদ শহীদ প্রমুখ। শাহ সাহেবের সময় একটি বড় ফেতনা ছিল মাকুলীন বা যুক্তিবাদীদের দাপট। তাদের মন-মগজ গ্রিক দর্শন ও আজমী বাতিল পন্থীদের বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল। শাহ সাহেব জবান ও কলম দ্বারা তাদেরকে ঘায়েল করতে থাকেন এবং জনসাধারণকে ইসলামের সঠিক শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকেন। একই সময় তাকে মনগড়া আজমী তাসাউফ ও ভন্ড গুমরাহ সুফীদের বিরুদ্ধেও কলম ধরতে হয়েছে।
শাহ সাহেবের মাজহাব অর্থাৎ মতবাদ সম্পর্কে মতবিরোধ থাকলেও তিনি তারই বিভিন্ন রচনায় তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তার সে সব উক্তি একত্রিত করলে এ সম্পর্কে সংশয়ের কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। এখানে আমরা একটি মাত্র উক্তি তার গ্রন্থ আনফাসুল আরেফীন হতে উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন, আমি অধিকাংশ বিষয়ে হানাফী মাজহাব অনুযায়ী আমলকারী কাজেই সমস্ত থেকে অধিকাংশ বাদ দিলে আর যা অবশিষ্ট থাকে তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। মৌলিক বিষয়গুলো সকল মাজহাবেই এক ও অভিন্ন। কাজেই অধিকাংশ বিষয় বলতে শাহেব অধিকাংশ বিষয়গুলোকে বুঝিয়েছেন বলেই ধরে নিতে হবে। শাহ সাহেবের চিন্তা ধারার প্রভাব কেবল উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যেই সীমবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক পর্যাায়েও তা লক্ষ করা যায়। তিনি হানাফী মাজহাবের অনুসারী হওয়ায় বাংলাদেশেও তার চিন্তা ধারার ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ লেখক, সাহিত্যিক মরহুম সৈয়দ আলী আহসান শাহ ওয়ালিউল্লাহ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বাংলাদেশে শাহ সাহেবের চিন্তা ধারার প্রভাব সম্বন্ধে যা লিখেছেন, তা উদ্ধৃত করে এই নিবন্ধের উপসংহার টানতে চাই। তিনি লিখেছেন, শাহ ওয়ালি উল্লাহর রচনাবলী পাক-ভারতে বিশেষভাবে সমাদৃত। বিশেষ করে মওলবী মজদুদ্দীনের ব্যক্তিত্ব ও অধ্যাপনার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) শাহ সাহেবের চিন্তা ধারার প্রভাব বিস্তার লাভ করে। মওলবী মজদুদ্দীন ছিলেন শাহ সাহেবের শিষ্য। কলিকাতার মুসলমান সমাজ তার শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার জন্য ভারতের তদানীন্তন বড় লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের নিকট থেকে একটি ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি লাভ করে। এর ফলে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কলিকাতা শহরে বৈঠক খানা অঞ্চলে কলিকাতা আলীয়া মাদরাসা কায়েম করা হয়। এই মাদরাসার মাধ্যমে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তা ধারা বাংলার মাটিতে প্রভাব বিস্তার করে। পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন ধর্মী
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে আলিয়া মাদরাসা খ্যাত। (সমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।