Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ফিরে

ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

(গতকাল প্রকাশিতের পর)
বেলা বারোটা নাগাদ সাহায্য সামগ্রী বিতরণের প্রথম পর্ব শেষ হয়। সবাই তখন এরপর কী করণীয় তা জানতে চায়। ইউসুফ ও ফয়সাল আমাদের পরামর্শ দেয়। আঙ্গুল উঁচিয়ে ওরা দেড় দুই কিলোমিটার দূরের টিলা দেখিয়ে বলল, ওখানে বহু দুঃস্থ মানুষ আছেন, অনেকে সদ্য এসেছেন তারা সামান্যই ত্রাণ সামগ্রী পেয়েছেন, কষ্টে আছেন। যারা ত্রাণ সামগ্রী দিতে আসেন তারা প্রায় সবাই মাল সামান এনে হাতের কাছাকাছি যাদের পায় তাদেরই দিয়ে খুশি মনে ফিরে যায়। ফলে কেউ কেউ দফায় দফায় সাহায্য পায়, আর কেউ বা সামান্যই পায়, অনেক কষ্টে ক্লেশে তারা দিনাতিপাত করছে। যারা রিলিফ সামগ্রী দিতে যান তাদের এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার। খোঁজখবর নিয়ে ত্রাণ সামগ্রী দেয়া উচিত। তদুপরি প্রয়োজন সরকারিভাবে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা, কিংবা ‘কন্ট্রোল রুম’ খুলে সমন্বয় সাধন বা দিগনির্দেশনা প্রদান করা জরুরি। এতে সর্বত্র, সকলের কাছে সাহায্য সামগ্রী পৌঁছাবে- কেউ বঞ্চিত হবে না। যদি কোন গোষ্ঠী বা সংস্থা নিজেরা রিলিফ দিতে চান তাতে প্রশাসনের পক্ষ হতে বাধা না দিয়ে বরং যথাযথ এলাকা বা প্রার্থীদের চিহ্নিত করে তাদের বিতরণ করতে দেয়াই ভালো। কেননা যাঁরা রিলিফ দিতে যান তারা নিজ হাতে বিলিবণ্টন করলে এক ধরনের পরিতৃপ্তি বা প্রশান্তি বোধ করেন। দাতাদের মনে দ্বিধা সংশয় সৃষ্টি হতে পারে যে, আমাদের দেয়া জিনিসপত্র ঠিকমতো পৌঁছাল কি না। এতে বাধা দিলে দেশীয় রিলিফের প্রবাহ কমে যেতে পারে। আর এমন হলে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতির মধ্যে যে ব্যাপক সহানুভ‚তি সৃষ্টি হয়েছে, সাড়া পড়ে গেছে তা ক্ষু্ন্ন হতে পারে। আমার এক ছাত্র এসেছিল একটা পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র নিয়ে- কিন্তু স্থানীয় টিএনও সাহেব তাকে সেটা স্থাপন করতে না দিয়ে তিনি নিজেই করবেন বলে তাকে বিদায় করে দেন। সে যন্ত্রটি হস্তান্তর করে ক্ষুণœ মনে রংপুর ফিরে গেছে।
যাহোক, ড. ইফতিখার ওদের কথামত ঐসব প্রান্তিক অবস্থানের রিফিউজিদের কাছে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমিও তার কথায় রাজি হলাম। ট্রাকে এখন যেসব উপকরণ অবশিষ্ট আছে তা বস্তাতেই রয়েছে- প্যাকেট করার সময় হয় নেই। আমরা এসব জিনিস ঘরে ঘরে গিয়ে, দেখে শুনে যার যা প্রয়োজন তা হাতে হাতে দিতে চাই। সুজি চিনি ডাল প্রভৃতির বস্তা নিয়ে এবার যাত্রা শুরু হলো। মাথার উপর তখন সূর্য আগুন ঢালছে। সদ্য গাছপালা ঝোপঝাড় কেটে সাফ করা পাহাড় টিলায় তখন ভ্যাপসা গরম, রোদ। রাস্তাঘাট নেই, পায়ে চলার পথ রেখা কেবল সৃষ্টি হচ্ছে, দু’পাশে পলিথিনের তৈরি ছোট ছোট ঝুপড়ি। তার মধ্যে নারী শিশুদের দেখে খুব কষ্ট লাগে। ড. ইফতিখার ফয়সালকে সাথে নিয়ে সবার সামনে, আর পিছনে আমরা কয়েকজন। এক সময় ড. ইফতিখার দৃষ্টিসীমার প্রায় বাইরে চলে যান। শুধু তার সাদা ক্যাপটা একমাত্র নিশানা। কখনো চোখে পড়ে কখনো হারিয়ে যায়। আমি যেন আর পারছি না। পাহাড়-টিলার অমসৃণ ও কাদা বালু ভরা পথে আর এগোনো যায় না। সাথে রাখা বোতলের পানিও ফুরিয়ে গেছে। সকালে কয়েক পিস পাউরুটি ও কলা খেয়েছি, পিপাসা প্রবল, পানি নেই, পেটও খালি। ধারে কাছে নলকূপ দেখলাম না। হাঁটতে হাঁটতে একটা টিলার মাথায় পৌঁছে যাই। টিলার মাথাটা কেটে সমতল করে অনেকটা খোলা জায়গা বের করা হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকজন মুরুব্বী শ্রেণীর লোকদের দেখলাম। সেখানে বাঁশের খুঁটির উপর মোটা কার্টনের কাগজ ও পলিথিন শিট দিয়ে ছাদ বানিয়ে একটা বেড়াহীন ঘরমত কাঠামো দেখলাম। কাছে যেতেই মুরুব্বীরা সালাম বিনিময় করে বলে এটা তাদের জামে-মসজিদ। অবাক হয়ে গেলাম। যাঁদের নিজের থাকার ঘরই ঠিক হয় নাই, এ বেলা কী খাবেন তার কোন নিশ্চিয়তা নেই, নেই পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা, রোদ-বৃষ্টিতে সারাক্ষণ বিপর্যস্ত তারাই কিনা সর্বাগ্রে তৈরি করেছেন মসজিদ। এতে তাদের ঈমান আকীদা যে কতটা মজবুত তা আন্দাজ করা যায়। উপরে পলিথিনের ছাদ নিচে অমসৃণ মাটির উপর বিছানো হয়েছে পলিথিন শিট। মুরুব্বীরা সেখানে জমায়েত হচ্ছেন জোহরের নামাজে শামিল হওয়ার জন্য। আমি সঙ্গীদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছি, একাকী হয়ে গেছি, এমন কি তৌহিদও নেই আশেপাশে। মসজিদের ছাদের নিচে মুরুব্বীরা বসবার জন্য সাদর আহ্বান জানালেন। একটা পুরানো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে দিয়ে সম্মান দেখান তাঁরা। আমি কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম। খেয়াল করে দেখি অদূরে আমার সামনেই মাটিতে বসে আছেন মাদরাসার সেই প্রিন্সিপাল সাহেব। একে একে ওদের দু’একজন মুখ খোলেন, নানান কথা পাড়েন। আমি এমন একটি মওকাই খুঁজছিলাম। গণ-দেশান্তর, গণহত্যা ও তার পশ্চাৎভ‚মি সম্পর্কে প্রাইমারী ইনফরমেশন পেতে চাই। বর্তমান অবস্থাটি বুঝতে চাই। মুরুব্বী রোহিঙ্গাদের কথা হলো তারা নিজ দেশভূমি, বাড়িঘরে ফিরে যেতে আগ্রহী। এই রিফিউজি জীবন গøানিকর, কষ্টদায়ক। তাই তারা ফিরতে চান স্বদেশে, চেনা জায়গায়। কিন্তু মায়ানমার সরকার ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা ভয়ঙ্কর সহিংসতা দেখিয়েছে, যুগের পর যুগ যুলুম, অমানবিক আচরণ এবং শেষে তাদের রাষ্ট্রহীন গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। এসবের একটা বিহিত না হলে তারা ফিরে যাবে না। অন্যথায় তাদের নির্ঘাত প্রাণ হারাতে হবে। আমি তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। তারা বলেন, মায়ানমার সরকার- তার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা যে নৃশংসতা বছরের পর বছর ধরে চালিয়েছে, বাইরের লোক তা সামান্যই জানে। তাদের নিবৃত না করে দেশে ফিরে গিয়ে কোন ফায়দা নেই। এখন ওদের বিচার যেমন আমরা চাই, তেমনি আমাদের নাগরিকত্ব, মানবাধিকার ফিরে চাই। অন্যথায় এখানে না খেয়ে মৃত্যু হলেও আমাদের আফসোস নেই।
আরেকজন মুরুব্বী বল্লেন, ওরা আমাদের বাচ্চাদের লেখাপড়ায় বাধা দিয়েছে, এমনকি চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বহু মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরেছে- ঔষধপত্র পায়নি- হাসপাতালে ঢুকতে পারেনি। হিংস্র বৌদ্ধ সংগঠন মা বা থা গোষ্ঠীর সমর্থকরা মুসলমানদের একদম সহ্য করতে পারে না। ওদের হাতে অনেকের প্রাণ গেছে। কিন্তু প্রতিকার পাইনি। বরং সরকার তাদেরই ছায়া দিয়েছে। আমাদের পক্ষে কেউ কিছু বলেনি। আমরা সুচির প্রতি তাকিয়ে ছিলাম, সমর্থন সহযোগিতাও করেছি- কিন্তু তিনিও বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। সুচি এখন মিলিটারিদের হাতের মুঠোয়।
তাঁদের কথা আমি গভীর আগ্রহ ভরে শুনি। শুনতে চাই ফার্স্ট হ্যান্ড ইনফরমেশন হিসেবে। ভুক্তভোগীদের মুখ থেকে জানতে চাই ম্যাস মাইগ্রেশনের আসল রূপ ও রাষ্ট্রহীন মানুষের চিন্তা-ভাবনা। একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন পিছনের দিকে। তিনি নড়ে বসেন। বোঝা যায় পরিচ্ছন্ন রুচির মোটামুটি শিক্ষিত মানুষ। ভালো বাংলা বলেন। তিনি পরিচয় দিয়ে বলেন আমি ছিলাম এক সময় এলাকার চেয়ারম্যান। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আক্ষেপের সাথে বললেন, বৌদ্ধরা আমাকে কোন কাজ করতে দিত না, দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না, ওদের রক্তচক্ষু দেখে দেখে চেয়ারম্যানগিরির সময় পার করেছি। আজকে শুন্য হাতে এখানে এসেছি। আমার ছোট ছেলেটা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী ছিল। তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে কী হবে তা আল্লাহই জানেন। বলেই মাথাটা হেট করলেন- খুব সম্ভবত চোখের পানি লুকানোর জন্য। অন্য এজন মুরুব্বী আমার খুব কাছাকাছি মাটিতে বসেছিলেন। তিনি বললেন যে, শত শত বাচ্চা পোলারা এসেছে। অনেকে পথেই মারা পড়েছে। এমন অনেক বাচ্চা এখানে এসেছে যাদের মা-বাবার কোন সন্ধান নেই। এরা একাকী, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা, আত্মীয়দেরও খোঁজ নেই। ওদের কী হবে, কোথায় যাবে কে জানে- বলে আকাশের দিকে তাকালেন।
লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, সর্বস্ব হারিয়েছে। বহু পরিবার ভেঙে গেছে। ঐতিহ্যগত সমাজজীবন ছত্রখান হয়েছে। বালক-বালিকারা স্কুলের বাইরে, কৃষকের কোন জমি নেই- ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ। রাষ্ট্র তাদের অস্বীকার করেছে। তার উপর বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে এরা; অপহরণ, পাচার, যৌন হয়রানী, রোগ-ব্যাধি, অপুষ্টি ও অভিভাবকহীনতা শিক্ষা বঞ্চিত হওয়ার মত নানা সামাজিক সংকটের মধ্যে পড়বে এরা। কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হতে পারে, বেছে নিতে পারে বক্রপথ, দুষ্টচক্রের হাতে পড়ে হতে পারে বিভ্রান্ত। অথচ মানুষ হিসেবে ন্যায়বিচার এবং ১৯৮৯ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের শর্ত মোতাবেক অধিকার পাওয়ার দাবিদার এই শিশুরা। বিশ্ব সম্প্রদায় কী কিছু রিলিফওয়ার্ক করে, কতগুলো কাগুজে প্রস্তাব পাশ করেই দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে মনে করে? মুরুব্বীদের আলোচনা শুনে আমার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। কী এমন শক্তিধর এই সামরিক জান্তা যে, তাদের বাগ মানানো যাবে না। ভাবলাম, আমার কিছু বলা দরকার- বলার আছে। ওদের বললাম, আপনারা নিজেদের মধ্যে কলহ বিবাদ করবেন না, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করে চলবেন। নিজ নিজ সন্তানদের প্রতি সদা সর্বদা নজর রাখবেন। আবার অভিভাবকহীন বাচ্চাদের দেখা পেলে নিজেদের জিম্মায় রেখে দেবেন। মোটামুটি জানা চেনা হলে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করে নিবেন। অথবা সরকারের লোকদের খবর দেবেন, তাদের হাতে তুলে দেবেন। এইসব পথহারা, বা ইয়াতিম শিশুদের রক্ষা করা আপনাদের কর্তব্য- ওরা যাতে দালাল, আদম ব্যাপরীর খপ্পরে না পড়ে সেটা খেয়াল রাখবেন। আর মুসলমানদের এমন দুর্যোগের সময় খ্রিস্টান মিশনারীরা মহান দরদীর আলখেল্লা পড়ে উদয় হয়, সাহায্য-সহায়তা করতে চায়। ওরা নানা প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে ধর্মান্তরিত করতে চেষ্টা করে। সুযোগ মতো একদিন ফ্রি শিক্ষাদীক্ষা চিকিৎসা ইত্যাদির নামে দরিদ্র-অসহায় শিশুদের ভাগিয়ে নিয়ে যায়, শেষে নিজেদের ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। নজর রাখবেন, লোকজনদের বলবেন, এমনটা যেন না ঘটতে পারে। কিছু এনজিও আছে যাদের কাজকর্মও সন্দেহজনক। বাচ্চাদের তাদের থেকে সাবধানে রাখবেন। আর পারলে বইপত্র খাতা পেন্সিল যোগাড় করে বাচ্চাদের নিজেদের তত্ত¡াবধানে কাছাকাছি রাখবেন, অক্ষর জ্ঞান দিতে চেষ্টা করবেন, কাজে ব্যস্ত রাখবেন। লোকজন নিরবে আমার কথা শুনছিল। কেউ কেউ বা সম্মতি সূচক মাথা নাড়া দিল। তবে ক্ষুধা পিপাসায় আমার এনার্জি লেভেল ততক্ষণে অনেকটা নেমে গেছে। কথা শেষ করতে চাইলাম। বললাম যে, আপনারা বছরের পর বছর এতো জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন তার কারণ আপনারা মুসলমান। আত্মীয়-প্রিয়জন হারিয়েছেন, ভিটে মাটি ফেলে দেশ ত্যাগ করেছেন, আজ এখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন- তাও ঐ ইসলামী পরিচয়ের জন্যই। কাজেই ইসলামী পরিচয়কে কখনো মুছে যেতে দেবেন না। ইসলামের পথ থেকে নিজেদের এবং বাচ্চাদের বিচ্যুত হতে দেবেন না। ইসলামের আদর্শ-বিশ্বাস আমল আখলাককে আঁকড়ে থাকবেন। সন্তানদেরও সেই শিক্ষা দিবেন। তা না হলে আপনারা শীঘ্রই হারিয়ে যাবেন, ধ্বংস হয়ে যাবেন। রোহিঙ্গা নামক কোন মুসলমান গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকবে না।
ইতোমধ্যে মুয়াজ্জিন যোহরের আজান দিলেন। সে আজান কতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে তা আল্লাহ মাবুদই জানেন। কারা যেন এক বালতি পানি ওজুর জন্য আগে থেকেই এনে রেখেছিল। ওজু করে নামাজে শামিল হলাম। নামাজ শেষে নাতিদীর্ঘ দোয়া করলেন ইমাম সাহেব। নির্ভুল বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় মোনাজাত করলেন। শুনে খুব ভালো লাগলো। বিশ্বাসই হতে চায় না এই শুকনো মত বর্ষীয়ান মানুষটি, পবিত্র কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দিয়ে সুন্দরভাবে দোয়া সমাপ্ত করলেন। হয়ত অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাঁর। দোয়া শেষ হতে না হতেই ড. ইফতিখার মসজিদের কাছে এসে হাজির হলেন। ওজু করার পানি তালাশ করছেন। এই সুযোগে উপস্থিত মুসল্লীদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বললাম, ইনি হচ্ছেন ড. ইফতিখার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। উনি জিন্সের প্যান্ট ও ক্যাপ মাথায় দিয়েছেন- সেজন্য ভুল বুঝবেননা যেন। উনি একজন কোরানে হাফেজ, বাল্যকাল কেটেছে পবিত্র মক্কা শরীফে বাবার সাথে। ওনার বাবা ছিলেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক-দু’টোই, একজন মশহুর আলেমও বটে। সবাই অবাক হয়ে তাকায়, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত ড. ইফতিখারের দিকে। পরে নামাজের জায়গা করে দেয়ার জন্য কেউ কেউ সরে বসেন। নামাজের পর ড. ইফতিখারকে উপস্থিত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে দু’কথা বলার জন্য বললাম। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ড. ইফতিখার উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে সালাম দিয়ে পবিত্র কালামে পাক থেকে সুরা বুরুজ এর ৮ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন। তারপর সোজা কথায় বললেন, এই যে আপনারা আজকে মায়ানমারের চোখে দুশমন হয়েছেন বৌদ্ধদের হিংসার শিকার- এতো দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে আছেন তার কারণ একটাই যে, আপনারা মুসলমান- এক আল্লাহকে বিশ্বাস করেন, তার ইবাদত করেন। কাজেই সব অবস্থায় মুসলমানিত্বকে ধরে থাকবেন। এটাই যেন হয় আপনাদের বাঁচার, পরিচয়ের মূল অবলম্বন। আল্লাহর সাহায্য নিশ্চয়ই আসবে, ইনশাল্লাহ। আমরা কয়েকজনের সাথে মোসহাফা করে বিদায় চাইলাম। একজন হাত ধরে বললেন, এই মসজিদটা একটু ভালো করে তৈরি করা দরকার। কোন ব্যবস্থা করতে পারছি না। কোরান কিতাবও নেই যে পড়বো। আমি বললাম, নাসরুম মিলাল্লাহ ওয়া ফাতহুন কারিব। ওয়াদা করলাম, কোরান কিতাব যোগাড় করে দেওয়ার জন্য।
এবার ফেরত যাত্রা। হাঁটতে হাঁটতে ত্রাণের মালসামান কীভাবে বণ্টন করা হয়েছে, সমস্যা হয়েছে কিনা সেসব বিষয়ে রিপোর্ট মত করে আমাকে জানায় ড. ইফতিখার। ওর কর্মকৌশল ও অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টায় আমি মুগ্ধ হলাম, অভিভ‚ত হলাম। আমি যে দূরে যাইনি- সেজন্য সে সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, পথ-ঘাট খুব খারাপ, তার উপর রোদও প্রচন্ড, না গিয়ে ভালো করেছেন। আবার চড়াই উৎড়াই বেয়ে আমরা ফিরছি ক্যাম্পের প্রবেশ পথের দিকে। পথে পথে অগণিত নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধের ভিড়। অনেকে ইউনিসেফের দেয়া বড় ব্যাগ ভর্তি ত্রাণসামগ্রী মাথায় করে নিয়ে চলেছে। একটা টিলার উপর দিকে উঠছি সদ্য বানানো ধাপ পায়ে পায়ে অতিক্রম করছি- সামনে তাকিয়ে দেখি সকালবেলার সেই বালক কাশিম সেখানে ধাপের উপর দাঁড়িয়ে। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন