Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোরআনের প্রথম ফার্সি তর্জমা করেন ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)

| প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে. এস. সিদ্দিকী
উপমহাদেশে কোরআন ও হাদীস শিক্ষার প্রসারে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে যে মণীষীর অসাধারণ অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে তার নাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.)। ২৯ মোহাররম এ মহান মণীষীর ওফাত দিবস। হিজরী ১১৭৬/১৭৬৩ সালের এইদিন তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছরের কিছু বেশি। তার জন্ম হিজরী ১১১৪ সালের ৪ শাওয়াল মোতাবেক ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে জন্মস্থান ইউপির মোজফ্ফরনগরের কসবা। মোগল স¤্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর ইন্তেকাল করেন হিজরী ১১১৮ সালের ২৮ জ্বিলকদ মোতাবেক ১৭০৭ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি। এই হিসাবে স¤্রাটের ওফাত ও শাহ সাহেবের জন্মের মধ্যে ব্যবধান মাত্র চার বছর।
তার নাম আহমদ, কুনিয়াত বা উপনাম আবুল ফাইয়ায এবং ওরফে ওয়ালিউল্লাহ। সুসংবাদ হিসেবে তার নাম কুতুবুদ্দীন এবং তারিখি নাম আজীমুদ্দীন। তার পিতার নাম আবুল ফয়য শায়খ আবদুর রহীম। তিনি একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও বিখ্যাত বুজুর্গ ছিলেন। তিনি সেই মহান ব্যক্তিত্ব যিনি বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ ফতোয়ায়ে আলমগিরী সম্পাদনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার দাদার নাম ওয়াজিহুদ্দীন আল উমরী (ওফাত ১১৩১ হিজরী)। শাহ সাহেবের বংশধারা পিতার দিক থেকে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) এবং মাতার দিক থেকে ইমাম মুসা কাজেম (রহ.) পর্যন্ত পৌঁছে।
দশজন স¤্রাটের যুগে শাহ সাহেব: ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী ঘটনা হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) তার ৬১/৬২ বছরের জীবনে দশজন মোঘল স¤্রাটের রাজত্ব দেখেছেন। তিনি ইন্তেকাল করেন দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে। তিনি অন্ধ ছিলেন। তার উপাধি ছিল মাকহুল। সম্ভবতঃ দৃষ্টিশক্তিহীন হওয়ার কারণে তিনি চোখে সুরমা ব্যবহার করতেন বলে তাকে মাকহুল বলা হতো। তিনি হিজরী ১১৭৩ হতে ১২২০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। স¤্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেব হতে দ্বিতীয় শাহ আলম নাবীনা মাকহুল পর্যন্ত দশজন বাদশাহের রাজত্বকাল পেয়েছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)। আর এসমগ্র যুগটাই ছিল মোগল সা¤্রাজ্যের পতনের সূচনা ও সমাপ্তির যুগ। নাবীনা মাকহুল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে শাহ সাহেবের ইন্তেকালের দুই বছর পর ক্লাইভ এলাহাবাদ নামক স্থানে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী বাদশাহের কাছ থেকে নিয়ে কোম্পানির নিকট সমর্পণ করে। শাহ সাহেবের ওফাতের পূর্বে দিল্লীতে মোহাম্মদ শাহের সময়ে যে গোলযোগ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল শাহ সাহেব তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। হেজাযে অবস্থান করে সে সময় তিনি উসমানীয় সা¤্রাজ্য ও অন্যান ইসলামী রাষ্ট্রগুলার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
ইতিহাস পাঠকবর্গের অজানা থাকার কথা নয় যে, পূর্বে বর্ণিত বাদশাগণের যুগে হিন্দুস্থান কী কী ভয়ংকর ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন ছিল এবং কী কী আতংকজনক ঘটনা সেখানে ঘটছিল, ইতিহাসে তার বিষয় বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে শাহ সাহেবের আবাসস্থল দিল্লীতে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব পড়েছিল এবং তাতে তিনিও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি বৈপ্লবিক প্রশাসন কর্মসূচী সরকার পরিচালনার জন্য প্রণয়ন করেন। তার এ রাজনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল তার একটি ঐতিহাসিক স্বপ্ন, যার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ছিল একটি সত্যিকারের খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কথাটি এইভাবে বলা যায়, শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) ইসলামকে একটি বিপ্লবী ধর্ম বলে অভিহিত করেন। বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্য পবিত্র কোরআনের যুক্তিপূর্ণ নির্দেশনাবলী নিয়ে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। তিনি মনে করতেন, ইসলাম মানুষের পথ প্রদর্শক, সমগ্র বিশ্বে এ ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সংগঠনের প্রয়োজন এবং এ উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রেরও আবশ্যক যার উপযুক্ত ও উত্তম স্থান মক্কা শরীফ।
রচনা গ্রন্থাবলী: ইমামুল হিন্দ হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) এর ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ও সংস্কারসূচক অবদানগুলোর মধ্যে গ্রন্থাবলী রচনা অন্যতম। কোরআনের ফার্সি ভাষায় পূর্ণাঙ্গ প্রথম তর্জমা ছাড়াও ফার্সি এবং আরবি ভাষায় কোনো কোনো লেখকের মতে ইসলামের নানা বিষয়ও বিভিন্ন দিকের ওপর দুই শতাধিক গ্রন্থ-পুস্তক রচনা সংকলন এক অনবদ্ধ অবদান। হায়াতে ওয়ালি নামক পুস্তকের লেখক গ্রন্থাবলির সংখ্যা একান্ন (৫১) উল্লেখ করার পর এই কথাও লিখেছেন যে, তার সংকলনগুলোর ধারায় আরো বহু গ্রন্থ রয়েছে এবং সে সমস্ত প্রাচীন কুতুবখানাসমূহে বিদ্যমান। কিন্তু লেখক কেবল প্রকাশিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো পূর্ব ও পশ্চিম পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি বহু গ্রন্থের লেখক, শুধু এতটুকু বলাই ঠিক নয়, বরং তিনি প্রত্যেক শাস্ত্রের ওপর কলম চালিয়েছেন এবং তাতে তিনি সূ²সূ² এবং নানা দুর্লভ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। কোরআন, তফসীর, হাদীস, ফেকা, সীরাত, ফালসাফা (দর্শন), তাসাওফ, (সূফীতত্ত¡) রাজনীতি এবং অর্থনীতি ইত্যাদি সকল বিষয়ের ওপর তার স্বতন্ত্র পুস্তক-পুস্তিকা রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব কাজ তিনি মাত্র ২৭/২৮ বছরের সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করেছেন।
গ্রন্থ রচনা সংকলনের ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) একটি নতুন ও স্বতন্ত্র রীতির প্রবর্তক ছিলেন বলে অনেক লেখক উল্লেখ করেছেন। তার উচ্চমানের আরবী রচনারীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে উপমহাদেশের খ্যাতনামা উলামায়ে কেরাম বহু মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন। বিগত শতকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম-মণীষী আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) (ওফাত ৩১ ডিসেম্বর ২০০০ খ্রিস্টাব্দ) এর মন্তব্যের পর আর কারো মতামতের প্রয়োজন পড়ে না। হজরত শাহ সাহেব একজন আজমী (অনারব) ও হিন্দুস্থানী (ভারতীয়) হওয়া সত্তে¡ও তিনি আরবী ফাসাহাত বালাগাতের এক অপূর্ব নমুনা পেশ করেছেন। যা আহেল জবান আরবরাও স্বীকার করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লামা নাদভী রহ. বলেন, শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব প্রথম হিন্দুস্তানী লেখক যার আরবী রচনাবলী (বিশেষত হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ) গ্রন্থে আহলে জবানের ন্যায় গতিশীলতা ও শক্তি এবং আরবদের ন্যায় আরবিয়ত বিদ্যমান এবং সেসব অসামঞ্জস্যতা অসংলগ্নতা হতে পবিত্র যেগুলো আজমী উলামা লেখকগণের আরবী রচনায় বিদ্যমান। উল্লেখ্য, আল্লামা নাদভী বর্ণিত, হুজ্জাতুল্লা হিল বালেগা গ্রন্থটি আলিয়া মাদরাসার টাইটেল ফেকা শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত বহুকাল থেকে।
কোরআনের ফার্সিতে প্রথম তর্জমা: উপমহাদেশে ফার্সিভাষায় প্রথম কোরান তর্জমা কখন, কে করেন, তার সঠিক তথ্য বলা কঠিন হলেও হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ তর্জমা করেন বলে সর্বসম্মত মত। বলা হয়ে থাকে, ভারত বর্ষে কোরআনের ফার্সি ভাষায় তর্জমা করেন মালিকুল উলামা শাহাবুদ্দীন হিন্দি দওলাতাবাদী (ওফাত ৮৪৯ হিজরী)। তিনি ছিলেন বাহরে মাওয়াজ ও বদীউল মাজান ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক। এটি কোরআনের পূর্ণাঙ্গ ফার্সি তর্জমা কিনা তা স্পষ্ট নয়।
শাহ সাহেবের তর্জমা সম্পর্কে বলা হয় যে, সে যুগে রাষ্ট্রের সরকারী ভাষা ছিল ফার্সি এবং তা সর্বসাধারণের কাছেও গৃহীত ছিল। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান ছিল যে, কোরআন তেলাওয়াত করলেই তার হক আদায় হয়ে যাবে। একারণেই কোরআন অনুবাদ করার প্রয়োজন দেখা দেয় এবং শাহ সাহেব ফার্সি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাও করেন। শাহ সাহেব মনে করতেন যে, কোরআন কোনো তফসীর ছাড়াই পড়ানো উচিত এবং ওস্তাদের কর্তব্য হচ্ছে, যেখানে কোনো জটিল বিষয় আসে, ছাত্রকে তার সমাধান দেওয়া। এরূপ করা হলে, তাতে ছাত্রের উৎসাহ-আগ্রহ বেড়ে যাবে, তার মেধারও বিকাশ ঘটবে এবং ক্রমে সে আরবী জানতে আগ্রহী হবে। উল্লেখ্য, তফসীর ব্যতীত শুধু কোরআনের মতন পড়ার প্রচলন করেন সর্বপ্রথম ভারতে শাহ সাহেবের পিতা শাহ আবদুর রহীম (রহ.)। শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও (রহ.) তার মহান পিতার এ পদ্ধতি বহাল রাখেন। ফলে এর ব্যাপক প্রচলন হতে থাকে, কিন্তু দরসে কোরআনের এ পদ্ধতি সাধারণ মাদরাসাগুলোতে চালু রাখা হয়নি।
কোফরের ফতোয়া: শাহ সাহেবের যুগে কোরআন মজীদের প্রতি তেমন গুরুত্ব প্রদান করা হতো না। উত্তম রেশমী জুযদানে সংরক্ষণ করা হতো, যাতে প্রয়োজনে শুভ-অশুভ যাচাই বা শপথ নেয়ার কাজ চলে, বাস্তব জীবনে তার দ্বারা কোনো উপকার নেয়া হতো না। শাহ সাহেব হারামাইন হতে প্রত্যাবর্তনের পর পরিস্থিতি অনুধাবন করে সংস্কার হিসেবে প্রচলিত ফার্সি ভাষায় তার অনুবাদ আরম্ভ করেন। অতঃপর হিজরী ১১৫৬/১৭৪৩ সালে তার দরস আরম্ভ করেন।
হজরত শাহ সাহেবের এ মহান সুকীর্তির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে উলামায়ে ‘সু’ (মন্দ আলেমগণ) তার বিরোধিতায় নেমে পড়ে এবং জণগণের মধ্যে তার বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও গোলযোগ সৃষ্টি করে এই বলে, ‘এই ব্যক্তি লোকদের মধ্যে গুমরাহি ছড়াতে চায়, কোরআনের তর্জমা পড়ে লোক পথ ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। সে ইসলাম ধর্মে এক মহাবেদাত (কু-সংস্কার) সৃষ্টি করেছে, পূর্ববর্তীরা (সলফে ছালেহীন) এমন কাজ কখনো করেননি, এমন অপরাধী এবং মন্দ বেদাআত কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে কতল করা ওয়াজেব ইত্যাদি ইত্যাদি।’
শাহ সাহেবকে হত্যার চক্রান্ত: বিরুদ্ধবাদীরা শাহ সাহেবের এ অতি উত্তম কাজকে বিকৃতভাবে এবং অতিরঞ্জিত করে ছড়াতে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে সাধারণ লোকদের প্ররোচিত ও উত্তেজিত করতে থাকে এবং শহরব্যাপী তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জাল বিস্তার করে। এমনকি একবার আসরের সময় শাহ সাহেব ফতহেপুরী মসজিদ হতে বের হচ্ছিলেন, এমন সময় বিদ্বেষীরা তাদের গুÐাদলকে সঙ্গে নিয়ে তাকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু তিনি কোনো রকমে বের হয়ে যান। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন