একটি জাতির জন্ম জিয়াউর রহমান
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মি: জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই
ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক : বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিে তিনজন মরহুম রাজনৈতিক নেতা খুবই সম্মানের অধিকারী। তাদের ছাড়া আরো মরহুম সম্মানীয় নেতা রয়েছেন, যাদের অবদান অস্বীকার করা হবে খুবই অন্যায়। তবুও ইতিহাসের নিরিখে তিনজনের নামই সামনে চলে। তারা হলেন- বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া ও মওলানা ভাসানী। তাদের অনুসারীদের ভেতর কিছু দ্ব›দ্ব থাকলেও এই মহান নেতাদের অবদান জাতীয় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ক্ষমতার অঙ্গনে আওয়ামী লীগ ও বিরোধী ক্ষেত্রে ন্যাপ (ভাসানী) ও পরবর্তীতে একই ক্ষেত্রে জাসদ থাকলেও সবাইকে টেক্কা দিয়ে জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সামনের কাতারে চলে আসে। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধর্মভীরু বাঙালি সমাজে মূল্য পায়নি। আর ন্যাপ (ভাসানী)ও সুবিধা না করতে পাওয়ায় জিয়ার ডাকে বিএনপিতে ঢুকে পড়ে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী বিএনপিতে প্রাথমিকভাবে শতকরা ষাট ভাগ ন্যাপ (ভাসানী), ত্রিশ ভাগ মুসলিম লীগ ও বাকি দশ ভাগ অন্যান্য দল থেকে আসা সমর্থনকারী ছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে ন্যাপ ক্ষমতার সাধ না পেলেও (তবে অতীতে তার নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিল), ন্যাপ (ভাসানী)-এর নেতা-কর্মীরা জিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদার হতে সমর্থ হয়। অথচ জাসদ খুবই সুগঠিত দল হওয়া সত্তে¡ও সফলতার মুখ দেখেনি। তারা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কি সেই আকর্ষণ যা জনগণ লুফে নেয় জিয়ার নেতৃত্বে? যে কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সফল হয় ঐ একই প্রকার কারণে জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির হয় জয়জয়কার। আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রব্বানী দর্শন, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন না করার ওয়াদা করে সাধারণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক মুসলমানী টুপি পরে দলের আদর্শ প্রচারে সারা দেশ ঘোরেন। তিনি একজন ঘাঁটি বাঙালি মুসলমান ছিলেন। তার লেখা বই বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম, ইসলাম দ্য অনলি সলুশন (১৫০ মোগলটুলী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত) ও অন্যান্য লেখায় দলের আদর্শ স্পষ্ট হয়। বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম গ্রন্থের সূত্র হিসেবে শামসুল হক সহকারী ইকবাল, আল্লামা আজাদ সোবহানী ও তমদ্দুন মজলিসের নেতা আবুল হাশিমের লেখার উল্লেখ করেছেন। এই বইয়ের একটি নিবন্ধের নাম রবুবিয়াৎ-এর স্তর তখনকার আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতারা যে কতটা তমদ্দুন মজলিসের দ্বারা প্রভাবান্বিত, তা এটা প্রমাণ করে এই বইয়ে হক লেখায় এখন নিঃসন্দেহে একথা বলা যেতে পারে, যারা অন্ধ মার্কসবাদী যারা মনে করেন মার্কসবাদ অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত তারা ভ্রান্ত। ইসলাম সম্পর্কে সম্যক ও সত্যজ্ঞান না থাকার দরুনই তারা এ দাবি করেন। মানবতা ও সৃষ্টি পুরোপুরি মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠবেইÑ দুনিয়ায় চিরন্তন শান্তি বা ইসলাম কায়েম হবেই। (পৃষ্ঠা ১০-১১)।
শামসুল হক আরো লিখেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতবাদ সমাজ বিধান মানুষকে চিরন্তন সুখ, শান্তি, উন্নতি প্রগতি ক্রমবিকাশ ও পূর্ণতা প্রাপ্তির সন্ধান দিতে পারে না। চরম পরিতাপের বিষয় এই যে, মুসলমানরাও জীবন ও জীবনাদর্শ সম্পর্কে আজ কমবেশি এ দু’টি বিপরীতমুখী পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা (সাম্যবাদী ও পুঁজিবাদী) এ ভাবান্বিত। ফলে তারাও দিশেহারা বর্তমান জগতকে সঠিক পথ নির্দেশ করতে পারছেন না। (পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫)। এই ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের দর্শন, যা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে বিশাল বিজয় এনে দেয়। জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সেই ইসলামী আদর্শেরই আশা শোনান জাতিকে। জিয়া আসলে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুরই উত্তরসূরি যদিও কেউ কেউ হয়তো এ মূল্যায়নে দ্বিমত পোষণ করবেন। আমাদের তিন মরহুম নেতাই ছিলেন খাঁটি বাঙালি মুসলিম। বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল ধারাকে তারা ধারণ করেন। শেখ মুজিব তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লেখেন ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে একটা দল আমরণ মুসলমান, আর একটা বাঙালি’ (পৃষ্ঠা ৪৭)।
আজ যদি এই তিন মহান নেতার ‘টিম’টা থাকত, দেশের ও জাতির মহা কল্যাণ হতো। তারা বেঁচে থাকলে বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি সঠিক অবস্থানে থাকত। তাদেরই ‘গাট্স্’ ছিল জাতির সম্মান রক্ষার মনোবলে। জিয়া কোনো সময় বঙ্গবন্ধুবিরোধী ছিলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর নামেই তার ঘোষণা সংশোধন করে রেডিওতে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তার পররাষ্ট্রনীতি আরো জোরালো হতো, যা করার সুযোগ জিয়ার ভাগ্যে আসে। জিয়া যা করেছিলেন পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ক্রমান্বয়ে তাই করতেন, কারণ দু’জনই ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। জিয়া আসলে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতিকে ‘ফাইন টিউনিং’Ñ আরো শাণিত করেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ও উন্নয়ন করে যার সূত্রপাত বঙ্গবন্ধু করেন। চীনের সঙ্গে যোগাযোগও বঙ্গবন্ধু শুরু করেন। জিয়া তা আরো স্পষ্ট রূপ দেন।
জিয়া সম্পর্কে অযথা চরিত্র হনন করা হয় এই বলে যে, তিনি পাকিস্তানি এজেন্ট ইত্যাদি। এগুলো রাজনৈতিক ঈর্ষার প্রকাশ। জিয়া তো ছিলেন চট্টগ্রামে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক। ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্য রাতে জিয়া তার অনুগত বাঙালি সৈনিকসহ বিদ্রোহ করলেন এবং নিজের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়াকে বন্দী করেন। যিনি পরে নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধা (অবসরপ্রাপ্ত) মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক আমাকে এই তথ্য সঠিক বলে জানিয়েছেন। এটা এমন এক দুঃসাহসিক ঘটনা যা পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে টেনে নেয়। জিয়ার পরিবার তখন ঢাকায়। জিয়া এমন ঝুঁকি নিলে বিদ্রোহ ব্যর্থ হতো। তাহলে তাকে পাক বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াডের সম্মুখীন হতে হতো। এরপরও রয়েছে তার কালুরঘাটের রেডিও ঘোষণা। তার এসব সামরিক তৎপরতায় তখন বঙ্গবন্ধুর পর তাকেই পাকিস্তানের প্রধান শত্রæ মনে করা হতো। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলা হচ্ছে। এটা দৃঢ়ভাবে বলা যেতে পারে যে, জিয়াসহ বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানী কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের এজেন্ট ছিলেন না। তারা ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। মৃতদের চরিত্র হনন হাদিসবিরোধীও। জিয়া একজন খাঁটি বাঙালি মুসলমান ছিলেন, যিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপরও ছিলেন উদার, যা তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নীতিতে সুস্পষ্ট।
লেখক : গবেষক ও ইতিহাসবিদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।