পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বহু প্রত্যাশিত তিস্তার পানিচুক্তি আবারো ভারতীয় টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণের শিকার হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের সময় (সেপ্টেম্বর ২০১১) প্রথম তিস্তাচুক্তি সম্পাদনের কথা থাকলেও ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার অজুহাতে তা সম্ভব হয়নি। অত:পর মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতকে খুশি করতে আমাদের সরকার সম্ভাব্য সব কিছুই করেছে। তাদের সত্তুর বছরের প্রত্যাশিত বাণিজ্যিক করিডোর-ট্রান্সশিপমেন্ট, বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও ঝুঁকিপূর্ণ চুক্তি হয়েছে একতরফাভাবে ভারতের স্বার্থে। বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা এবং তিস্তার পানিচুক্তি। মনমোহন সিং-এর পর নরেন্দ্রমোদিও বাংলাদেশের সাথে যথাশীঘ্র তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কাছ থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ অনেক কিছু পাওয়ার পর উভয় দেশের সরকারের পক্ষ থেকে দুই দেশের সম্পর্ককে অভূতপূর্ব নতুন উচ্চতায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সম্পর্কের এই উচ্চতার মাত্রা কি, সংজ্ঞা কি এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তা এখনো দুর্বোধ্য রয়ে গেছে। কারণ ভারতের আধিপত্যবাদী টালবাহানার কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রধান নদী পদ্মার বেশিরভাগ শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। পানির অভাবে তিস্তাপাড়ের জনপদে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিস্তা সেচপ্রকল্প অকেজো হয়ে পড়েছে, সেখানকার লাখ লাখ কৃষকের হাহাকার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের নদী বিধ্বংসী ষড়যন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগ শুরু করেছিল যতই দিন যাচ্ছে সেই ষড়ন্ত্রের জাল ক্রমেই আরো বিধ্বংসী চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। মূলত: নব্বই দশকের শেষদিকে তিস্তার উজানে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকে দ্রুত তিস্তার পানি প্রবাহে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। একটি ট্রান্সবাউন্ডারি নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় পক্ষ তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের সাথে কোন আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। ইতিপূর্বে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের পর আনুষ্ঠানিক কোন পানিবণ্টন চুক্তি না করেই চল্লিশদিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার কথা বলে সেই যে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার শুরু করেছিল তা আর কখনো বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তির পর থেকে বাংলাদেশ কখনো পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ডেল্টা বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। উজান থেকে বয়ে আসা নদীর পলি দ্বারা হাজার হাজার বছরে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের বুক চিরে বয়ে যাওয়া সে সব নদীর প্রবাহের উপর এ দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অস্তিত্ব নির্ভরশীল। অর্থাৎ নদীই হচ্ছে বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশের কৃষিব্যবস্থা, খাদ্যনিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক অস্তিত্বের প্রাণভোমরা। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা ও জনপদের অস্তিত্ব নদীপ্রবাহের উপর নির্ভরশীল হওয়াই স্বাভাবিক। আর ভারত বাংলাদেশের নদীগুলোকেই যেন তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে সব নদীর পানিপ্রবাহ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশকে তার অস্তিত্বের প্রশ্নে তার উপর নির্ভরশীল রাখতে চাইছে।
তিস্তার পানিচুক্তির প্রশ্নে ভারতের পক্ষ থেকে বার বার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ার পর সবশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে একটি সম্ভাব্য টাইমলাইন হিসেবে ধরা হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরের কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে ইতিমধ্যে একাধিকবার তারিখ পেছানো হয়েছে এবং চলতি মাসের শেষদিকে এ সফরের সম্ভাবনার কথা বলা হলেও এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর আগামী সফর যখনই হোক না কেন, তিস্তার পানিচুক্তি আপাতত: হচ্ছে না বলেই ধরে নেয়া যায়। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের দিল্লী সফরেও তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা না থাকলেও অন্য ৬টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা ও চুক্তির প্রাথমিক সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছয় নদী হচ্ছে- মনু, মুহুরি, খোয়াই, গুমতি, ধরলা ও দুধকুমার। তিস্তার পানিচুক্তিতে ব্যর্থ হয়েই সরকার এই ৬ নদীর পানিবণ্টন প্রশ্নটি সামনে এনেছে বলে ধরে নেয়া যায়। যেখানে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকার পরও পানির অভাবে পদ্মার শত শত শাখানদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে, তিস্তার শাখানদীগুলো মরে গেছে এবং তিস্তা সেচপ্রকল্প অকার্যকর হয়ে পড়েছে, সেখানে এসব প্রধান নদীর পানি সমস্যার সমাধান অনিশ্চিত রেখে নতুন করে ৬ নদীর পানি বণ্টনের আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসার হেতু দুর্বোধ্য। এমনকি অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসছে না। ছয় বছর আগে মনমোহন সিং’র বাংলাদেশ সফরের কয়েক ঘণ্টা আগে অনিশ্চিত হয়ে পড়া তিস্তা চুক্তিটি ২০১৫ সালে নরেন্দ্রমোদির সফরের সময় বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ বাংলাদেশকে যৌথ ঘোষণায় ‘যথাশীঘ্রই তিস্তাচুক্তি’র মুলা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর আরো দুই বছর পেরিয়ে এখন কালক্ষেপণের পুরনো টালবাহানাই দেখা যাচ্ছে। গত চারদশকেও পানি সমস্যার দ্বিপাক্ষিক সমাধানের চেষ্টায় কোন ফল পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ নদনদী অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এখন নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নেই বাংলাদেশকে গঙ্গাব্যারাজ, অববাহিকাভিত্তিক নদীব্যবস্থাপনাসহ পানি সমস্যাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।