Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

আবদুল্লাহ আল মেহেদী | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

গত বছরের নভেম্বর মাস জুড়ে মানুষের মুখে মুখে খবর ছিল ব্যাংকিং পরিস্থিতি নিয়ে। দেশের গণমাধ্যমগুলো বেশ ব্যস্ত ছিল বিশেষ করে এই বিটে যারা কাজ করে, তাদের নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। এখনও পুরোপুরি কাটেনি ঘোর। চরম দুর্নীতি আর লাগামহীন অব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কুড়িখানেক ব্যাংক সম্পর্কে। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ রেমিটেন্স আহরণকারী শরিয়াহ ধারায় চালিত ইসলামী ব্যাংক অনিয়মের টপ লেভেলে। সব মিলিয়ে ব্যাংকখাত নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে আছে।

সবচে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানে আছে অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের অভিযোগে। ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বড় মাপের ঋণ মানুষকে অবাক করেছে। মানুষ নতুন নতুন খবর দেখে শঙ্কিত ও বিস্মিত! কোনদিকে দেশের ব্যাংকিং ধারা? নিয়মের বালাই নাই তাহলে? নানা প্রশ্ন মানুষের মনে। আমানত নিয়েও আছে শঙ্কা। অনেকে আমানত উঠিয়ে নিয়েছেন তারল্য সঙ্কটের ভয়ে। আর এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে। চলতি অর্থবছরে শুরু থেকেই বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি দৃশ্যমান। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য কম আমদানি তুলনায়। গেল অক্টোবরে টানা চারমাসের মতো বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়তে হয় বাংলাদেশকে। ২০২২-২৩ তথা চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার দেশের বাণিজ্য ঘাটতি!

আইনের দুর্বলতর সুযোগ নিয়েছে নামকরা কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে লিপ্ত হয়েছে টাকা আত্মসাতে। সর্বগ্রাসী মনোভাব তাদের ফেরাতে পারেনি শৃঙ্খলায়। খেলাপি মনোভাব দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বেশ আগেই, যদিও তা সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি। খেলাপি ঋণের মামলার জটিলতা আর দীর্ঘতা এই সঙ্কট আরও বাড়িয়েছে। কবে এই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে তা অনিশ্চিত। তবে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি।

অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় ধীরে ধীরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান কমে আসছে। অক্টোবর মাসে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। যদিও জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এলসি খোলা নিয়ে নানা পদক্ষেপের কারণে এমন হয়েছে বলে মনে করা হয়। এটা সামান্য স্বস্তি আনলেও সুখকর নয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম চারমাসে বাংলাদেশ দুই হাজার ৫৫০ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পণ্য আমদানি করে এমন তথ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে। রপ্তানির হিসাবে বাংলাদেশ একই সময়ে এক হাজার ৫৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে। হিসাবে আমদানি ও রপ্তানি ঘাটতি ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার।

বছরের শুরু থেকে ডলার সংকট প্রকট! খোলা বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। রেমিট্যান্স কমছে ধারাবাহিকভাবে। এখনও রয়েছে এই ধারাবাহিকতা। প্রবাসীরা ভিন্নপথে টাকা পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও খুব বেশি সফলতা যে এসেছে তা বলা যাবে না। ডলার সংকট এখনও বাড়ছে। এতে রিজার্ভের পরিমাণও কমছে ধারাবাহিকভাবে। শঙ্কা থেকেই যায়।

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে একই সময়ের প্রথম চার মাস এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৮৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের চার মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। অক্টোবর শেষে সেবা খাতে দেশের আয় ২৯৭ কোটি ডলার আর ব্যয় হয়েছে ৪৩৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। ঘাটতির পরিমাণ ১৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, আগস্টে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ আর অক্টোবরে আসে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।

গত নভেম্বরের শুরুতে রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ৭২ বিলিয়ন থাকলেও নভেম্বরের শেষ দিকে তা কমে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এসব সংকটের মধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই ও আগস্ট মাসে টানা ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। বিদায়ী নভেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে মোট ১৭ হাজার ৬৩ কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে প্রবাসী আয়েও ধাক্কা! অর্থাৎ হ্রাস পাচ্ছে দিনে দিন প্রবাসী আয়।

১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক সম্মিলিতভাবে সেপ্টেম্বরে ৩২,৬০৬ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছিল, যা বছরের পর বছর ধরে চলা আসা এখাতের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থাকে তুলে ধরেছে। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী, জনতা, সোনালী, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এবং পদ্মা ব্যাংক। দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাংকগুলোতে সংঘটিত বড় ধরনের মূলধন ঘাটতির প্রধানতম কারণ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ১১টি ঋণদাতার মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল ১৩,৪৯১ কোটি টাকা। রূপালীর ক্ষেত্রে ২,৩৯০ কোটি টাকা এবং অন্য একটি সরকারি মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২,৩০০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২,৮৫১ কোটি টাকা। সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরিভাবে ব্যবস্থা না নিলে সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।

বড় মূলধনের ঘাটতি বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য একটি নেতিবাচক সংকেত দেয়। তাই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। আর্থিক দুর্নীতি এবং শ্রেণিবদ্ধ ঋণের উচ্চ অনুপাতকে ঘাটতির জন্য দায়ী। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের ৬০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বরে রেকর্ড ১৩৪,৩৯৬ কোটি টাকা বেড়ে ১,৪৩৬,২০০ কোটি টাকা হয়েছে। মোট বকেয়া ঋণের ৯.৩৬ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। এক বছর আগে খেলাপি ছিল ৮.১২ শতাংশ।

মূলধনের ভিত্তি গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় সেপ্টেম্বরে হ্রাস পেয়েছে, কারণ মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর) ১১.০৮ শতাংশের বিপরীতে ১১.০১ শতাংশে সঙ্কুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্পের মূলধনের ভিত্তিও দক্ষিণ এশিয়ার সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় দুর্বল। যদি কোনো ব্যাংক মূলধনের ঘাটতির সম্মুখীন হয়, তাহলে তার ধাক্কা শোষণ করার ক্ষমতা কমে যায়। ২০২১ সালে, পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো ১৮.৭ শতাংশের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত বজায় রেখেছিল, যেখানে শ্রীলঙ্কায় এটি ছিল ১৬.৫ শতাংশ এবং ভারতে ১৬.৬ শতাংশ। ব্যাংক খাতে অনিয়মের ধারা অব্যাহত থাকলে মূলধনের ঘাটতির অবস্থার উন্নতি হবে না। তাই বিরাজমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাংকগুলোর মূলধনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব বিবেচনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সম্প্রতি আরও উদ্বেগের কারণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায়, স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি, যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি-সম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরস্পর সম্পর্কিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ে। আবার জবাবদিহি থাকলে স্বচ্ছতা বাড়ে, এটা সবার জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে।


লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন