Inqilab Logo

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শেয়ারবাজারকে বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্রে পরিণত করতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ব এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে করেছে বিপর্যস্ত। অর্থনীতির পণ্ডিতরা বারবার পূর্বাভাস দিয়ে আসছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। সেখানে কোথায় যেন বাংলাদেশ নিয়ে বরাবরই আশাবাদী দাতা সংস্থা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাগুলো। গত ২৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক সেবা দাতা সংস্থা ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস’-এর বার্ষিক রেটিং পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগের মতোই অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকবে এবং ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ক্রমাগত স্বাভাবিক হতে থাকবে দেশটির অর্থনীতি। শুধু তাই নয়, এ বছর প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জিত হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তাই-তো তারা বাংলাদেশের ঋণমান দীর্ঘমেয়াদে ‘বিবি-’ ও স্বল্পমেয়াদে ‘বি’ বহাল রেখেছে। ঋণমানের এই অবস্থান এবারই নতুন নয়, সেই ২০১০ সাল থেকে দীর্ঘ এক যুগ ধরে একই রেটিং পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির মহাবিপর্যয়ের শঙ্কার এই পর্যায়ে এটি বেশ সন্তোষজনক একটি খবর। এর কিছু লক্ষণও ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে। গত আগস্ট মাসে প্রাবাসী আয় বেড়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সঙ্গে পণ্য রপ্তানি গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের কারণে আমদানি চাপ কমে আসছে। অন্যদিকে গত অর্থবছর সর্বাধিক সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসে গেছে। ফলে ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি আরও জোরালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শেয়ারবাজার ও তার চিরায়িত স্বভাব (উল্টো চলা নীতি) থেকে বেরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। দু’মাস আগেও শেয়ারবাজারের সূচক ক্রমাগত কমতে কমতে মনস্তাত্ত্বিক সীমা ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নামে। সাধারণত আমাদের শেয়ারবাজারে সূচকের ৫ হাজার, ৬ হাজার, ৭ হাজার কিংবা ৮ হাজার পয়েন্টের বা যে কোনো সহস্রের অবস্থানকে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে মনস্তাত্ত্বিক সীমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সূচক যখন এসব সীমা অতিক্রম করে তখন বিনিয়োগকারীরা খুব খুশি হন এবং বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেন। আবার ঠিক একইভাবে সূচক এসব সীমার নিচে নামতে থাকলে এর উল্টো ঘটে। বিনিয়োগকারীদের মনে আতঙ্ক ভর করে, ফলে বাধাহীনভাবে সূচকের পতন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত ঈদ উল আজহার ছুটির পর একটানা যখন দরপতন চলছিল বাজারে। ঠিক তখনই বিএসইসির নেওয়া নানামুখী পদক্ষেপের কারণে শেয়ারবাজারে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। সূচক তখন সাড়ে ৬ হাজারের আশপাশে। লেনদেনেও গতিশীলতা ফিরে পায়। এই উত্থানপ্রবণতার পেছনে মোটা দাগে কী কারণসমূহ থাকতে পারে, তা খুঁজে দেখা যেতে পারে। ব্যাংক কর্তৃক শেয়ারবাজারে ক্রয়কৃত শেয়ারের মূল্যকে ‘বাজারমূল্য’ হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে একটি সার্কুলার জারি করে। ফলে অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বাজার-সংশ্লিষ্টদের আশা, বহু প্রতীক্ষিত এই সিদ্ধান্তের ফলে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ুক বা না বাড়ুক, শেয়ার বিক্রির চাপ কিছুটা কমবে। এছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত ব্যাংক প্রতি ২০০ কোটি টাকার বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন পৃথক তহবিল-তো আগে থেকেই চালু রয়েছে। পাশাপাশি শেয়ারবাজারের উন্নয়নে ও শক্তিশালী বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের নীতিসহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেয়ারবাজারের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে মূল যে প্রভাবকটি মন্ত্রের মতো কাজ করেছে বলে ধরা হয়, তা হলো, ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারদরের সর্বনিম্ন সীমা। শেয়ারবাজারের টানা পতন ঠেকাতে যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিশাহারা, ঠিক তখন গত ৩১ জুলাই ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। এ সীমা আরোপের ফলে নির্ধারিত দামের নিচে নামতে পারবে না আর কোনো শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দাম। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন আব্দুর রউফ তালুকদার, যা বিনিয়োগকারীদের মনোজগতে আস্থা বৃদ্ধি করেছে। কারণ, এক যুগ ধরেই শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করছে বিনিয়োগকারীরা। এই যুক্তিহীন দ্বন্দ্ব ও কোন্দলই ছিল আমাদের শেয়ারবাজারের অন্যতম সৌন্দর্যহীনতা। তাই শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট যে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানের পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের মনে আশা জাগায়। এমনকি বড় কোনো হাই নেটওয়ার্ক ইন্ডিভিজুয়াল বিনিয়োগকারীর মনোবেদনাও একটি বিনিয়োগের ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।

এর আগে একবার ২০২০ সালে করোনা মহামারির আতঙ্কে শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ১৯ মার্চ সরকারের নির্দেশে প্রথমবারের মতো শেয়ারদরের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দেয় বিএসইসি। পাশাপাশি বিএসইসির নেতৃত্বের বদল হয়। এ কারণে শেয়ারবাজারে ধীরে ধীরে গতি ফিরতে শুরু করে। এক পর্যায়ে গত বছরের ১০ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক ৭ হাজার ৩৬৭ পয়েন্টে সর্বোচ্চ সীমায় উঠে। কিন্তু সূচকের ৭ হাজার পয়েন্টের ওই অবস্থান ১৫ দিন বা মাত্র ১১ কার্যদিবসের মাথায় অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর ধারাবাহিকভাবে পতন হয়ে সূচক নেমে আসে ৬ হাজার ৮৮৫ পয়েন্টে। এর পর সূচক বেশ কয়েকবার ৭ হাজার পয়েন্টের মাইলফলক অতিক্রম করলেও স্থায়ী হয়নি। আরও ভাবনার বিষয় হলো, গত এক বছরে অন্তত ৭ লাখ বিনিয়োগকারী নিরাশ হয়ে বাজার ছেড়েছে। সিডিবিএলের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের ২৯ জুন শেয়ারবাজারে বিও হিসাব ছিল প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজারে। এর মধ্যে গত জুন-জুলাই মাসেই বিও হিসাব সংখ্যা কমেছে ২ লাখেরও বেশি। এক বছরে ২৮ শতাংশ বা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগকারী যদি বাজার ছেড়ে যায় তা হলে বলতে হয়, বাজারে স্থিতিশীলতা আশা করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক অলীক ভাবনার মধ্যে এটি একটি, যা তাদের আত্মবিশ্বাসের একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়ি। আরও গভীরভাবে ব্যাপারটি খতিয়ে দেখলে পাওয়া যায়, টানা ৯ মাস পতনের পর আগস্ট মাসে সূচক ও লেনদেনে ইতিবাচক প্রবণতা এসেছে। ওই মাসের ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ১৫ দিনে ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ৫০০ পয়েন্ট। দুর্ভাবনার বিষয় হলো, মৌলভিত্তি কোম্পানিগুলোর দর এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ বাজারে সূচক কমায় বড় কোম্পানিগুলো ভূমিকা রাখলেও সূচক বাড়ায় ভূমিকা রাখছে দুর্বল কোম্পানি। এটি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ফলে বাজারের এই তথাকথিত স্থিতিশীলপ্রবণতা কতদিন টিকবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। দুর্বল কোম্পানির নাড়াচাড়ায় বাজারের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে শেয়ারবাজারে আবারও মন্দাভাব দেখা দেয়। এ রকম একটি খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা দেখা যায় বাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বহু আগে থেকেই শেয়ারবাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। আমাদের শেয়ারবাজারের প্রধান সমস্যা হলো, এটি বারবারই কারণে-অকারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারায়। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার কখনো একা চলতে শেখেনি অথবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাই এক রকম রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অনেক নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারী এখন সক্রিয় হচ্ছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত যেসব তথাকথিত বড় স্মার্ট বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করেছিল, তাদের অনেকেই আবার শেয়ার কিনতে শুরু করেছেন। তাছাড়া জুন-জুলাইতে বাজার যখন একেবারে তলানিতে তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বিগবিদিক হয়ে হাই নেটওয়ার্ক ইন্ডিভিজুয়ালদের বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানায়। তারাই এখন বাজারে আতিথেয়তা গ্রহণ করছে বলে অনেকে মনে করেন। তা বাজারে শেয়ারদরের উত্থান চিত্রেই বোঝা যায়। তা হলে বাজার স্থিতিশীলতার উপায়, বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। কোনো প্রকার কৃত্রিমতা দীর্ঘমেয়াদে বাজারের জন্য ভালো নয়। চাহিদা অনুযায়ী ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার বাড়াতে হবে। একটি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়ে যখন ভালো লভ্যাংশ প্রদান করবে তখন বাজারে এমনিতেই প্রকৃত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। আর বাজারেও স্থিতিশীলতা দেখা দেবে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য, বরাবরই আমাদের শেয়ারবাজার সুশাসনের বিচারে বিশে^র অন্যান্য বাজারের চেয়ে পিছিয়ে। ফলে এটি নিরাপদ বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। জনগণ শেয়ারবাজারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এই জায়গাগুলোতে মনোযোগ বাড়াতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পরিণত করতে হবে।

লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেয়ারবাজার

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
২৫ জানুয়ারি, ২০২২
৪ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন