Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আত্মহত্যা প্রতিকারে ইসলাম

এ.এস.এম.মাহবুবুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

বর্তমানে আত্মহত্যা মারাত্মক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগেও আত্মহত্যা মামুলি বিষয় ছিল না কিন্তু এখন এতটাই মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোন সমস্যা বা দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হলেই নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত খবর দেখে মনে হয় এই প্রজন্মের কাছে আত্মহত্যা ট্রেন্ডিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও এই পথ বেছে নিচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার ব্যাপারে সচেতন করতে না পারলে এই সামাজিক মহাব্যাধি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। তাই আত্মহত্যা নিয়ে লিখার ইচ্ছা পোষণ করেছি।

আত্মহত্যা হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে। বিশ্ব সংস্থা-এর মতে সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশ প্রধান কারণ। তবে ১৯ বছর থেকে ২৫/৩০ বছর বয়সী যুবক-যুবতীরা বেশি আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দশম। আর পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি। বিবিএসের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। গড়ে প্রতিদিন মারা যায় প্রায় ৩০জন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, গত বছর বাংলাদেশে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তন্মধে ৬৫ জন ছেলে শিক্ষার্থী ৩৬ জন মেয়ে। জরিপ অনুযায়ী বলা যায়, যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যা মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর ৬১.৩৯ ভাগ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন যা মোট শিক্ষার্থীর ২২.৭৭ শতাংশ। বাকিরা মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশবিদালয়সহ অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এইতো শুধু মে মাসেই ঢাবি, রাবি, জাবি ইবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যা করেছে ৬ জন। আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী ২০২০ সালে আত্মহত্যা করেছে ৭৯ জন। গবেষণায় আরো জানা যায় যে, ডিপ্রেশন, সম্পর্কের অবনতি, পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, বেকারত্ব, দারিদ্র, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ইত্যাদি এগুলোই আত্মহত্যার প্রধান করণ।
আল্লাহর প্রতি শিরক স্থাপনের পর সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হলো আত্মহত্যা করা এবং ইমাম জাহাবী আত্মহত্যাকে ৭০ টি বড় পাপের মধ্যে ২৯ নাম্বারে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর আত্মহত্যাকে হারাম করেছেন এবং পবিত্র কোরআনে আত্মহত্যাকারীর জন্য পরকালে কঠোর আজাবের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘন করে আত্মহত্যা করবে তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)।
আত্মহত্যাকারীর জন্য হাদিসে কঠোর শাস্তির কথা এবং ভয়ানক পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জখম হয়ে (অধৈর্য হয়ে) আত্মহত্যা করে। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারি, হাদিস: ১৩৬৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করে, সে-ও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষ পান করতে থাকবে। আর যেকোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেট ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আত্মহত্যা কতটা ঘৃণিত বিষয় হলে রাসুল (সা.) আত্মহত্যাকারীর জানাযার ইমামতি করেননি তবে বাকিদের পড়তে বলেছেন। জাবের বিন সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হয়েছে, যে লোহার ফলা দ্বারা আত্মহত্যা করেছিল, ফলে তিনি তার জানাজার নামাজ আদায় করেননি।’ ( সহিহ মুসলিম )। মানব জীবনে হতাশা, পরাজয় , দুশ্চিন্তা, তিক্ততা, থাকবেই, এগুলো মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সবার জীবনে সেটা কোনো না কোনো সময় এসেই থাকে কিন্তু সর্বদা লেগে থাকে না। পজিটিভ এবং নেগেটিভ এই দুই চিন্তারই এক বিশাল জায়গা এই ধরনি।তাই পজিটিভ চিন্তাকে সমৃদ্ধ করে, সফল মানুষকে ফোকাস রেখে পজিটিভ চিন্তা নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেকদূর যাওয়া সম্ভব কেননা নখ বড় হলে যেমন আঙ্গুল কেটে ফেলতে নেয় ঠিক তেমনিভাবে সমস্যায় পতিত হলে সমাধান করতে হয় তবে নিজেকে শেষ করে নয়। আত্মহত্যা প্রতিকারে কিছু পয়েন্ট তুলে ধরা হলো :
ধর্মীয় জ্ঞান থাকতে হবে : প্রতিটি ধর্মের রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা ও বিধিনিষেধ। ধর্মের অনুসারী হিসেবে প্রায় সবাই নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পৃথিবীতে অধিকাংশ ধর্মেই আত্মহত্যা নিষেধ করা হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ইসলামেও আত্মহত্যা হারাম করা হয়েছে। প্রকৃতভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা ব্যক্তি কখনো আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে না। ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে প্রকৃতভাবে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার পরেও আত্মহত্যা করেছে কারণ তারা জীবনের মানে বুঝেছে, রবের থেকে যা পেয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছে। ধর্মপ্রাণ পরিবার হলে পরিবারের সদস্যদের জন্য ধর্মীয় বিধিনিষেধ পালন করা সহজ হয়। সন্তানরা ছোট থেকে দ্বীনি পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তাদের মধ্যে আনুগত্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ তৈরি হয়। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইসলাম ও নৈতিকতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনন গঠন করতে হবে।
ধৈর্য ধারণ করতে হবে, ধৈর্য একটি মহৎ গুণ, যার ফলাফল অত্যন্ত সুমিষ্ট হয়। মানবজীবনে ধৈর্যের চেয়ে কল্যাণকর আর কিছু নেই। এই জীবনে যে ধৈর্য ধারণ করতে পেরেছে সেই ব্যক্তিই সফল হয়েছে।আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩)। যে ধৈর্য ধারণ করতে পারে নাই সেই ব্যর্থ হয়েছে। তাই রব্বে কারিমের ফয়সালা মেনে নিয়ে আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে তবেই আত্মহত্যা নামক বাজে চিন্তা মাথায় আসবে না।
সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করা : যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করতে হবে। অল্পতেই নিরাশ হওয়া যাবে না, আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না।’ (সূরা জুমার : ৫৩)। পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সংকট থেকে মানুষ আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়। দুঃখ, কষ্ট , হতাশা, দুর্দশা স্থায়ী হয় না তাই আত্মহননের পথ বেছে না নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সুখের আশা রাখতে হবে । কেননা আল্লাহ কোরআন মাজিদে এরশাদ করেন , ‘কষ্টের সঙ্গেই তো সুখ আছে। নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গেই সুখ আছে।’ (সূরা ইনশিরাহ : ৫-৬)। আরও বলেন , ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক : ৩)। আল্লাহ পাক অন্যত্র এরশাদ করেন, ‘যারা পথভ্রষ্ট তারা ব্যতীত আর কে তার রবের অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়?’ (সূরা হিজর-৫৬)। তো দিনশেষে যারা আল্লাহর ওয়াদায় ভরসা রেখে সামনে এগিয়ে যায় সে কোনোভাবেই হতাশ হওয়ার কথা নয়, প্রকৃতপক্ষে যারাই ভরসা পায় না তারাই দিনশেষে আত্মহত্যা করে। জীবন আপনার, ইচ্ছাও আপনার, নিজেকে শেষ করবেন নাকি অন্য এক ভোরের আলোর অপেক্ষা করবেন?
অপসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা : সমাজে অপসংস্কৃতির কালো থাবা দিনদিন বেড়েই চলছে।
এই কালো থাবা যেমন যুব সমাজকে আত্মহত্যা প্রবণ করে তুলছে ঠিক তেমনিভাব জাতির সুউজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের জন্য পরিশ্রমহীন ভূমিকা পালন করছে। কিছু বিদেশী চ্যানেলে দেখানো হয় পারিবারিক কলহ, বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য মান অভিমানে আত্মহত্যা করা। নগ্নতা, বিবাহবহির্ভূত রিলেশন তো আছেই। সুতরাং নগ্নতা, অশ্লীলতা, অপসংস্কৃতি বন্ধ করে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করলে তবেই আত্মহত্যা প্রতিকার করা সম্ভব।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতে, কবিরা গুনাহকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, আর সকল আলেমদের ঐক্যমতে আত্মহত্যা করা কবিরা গোনাহ তবে আত্মহত্যাকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়।সুতরাং শিরক ছাড়া অন্য সব গোনাহ আল্লাহ চাইলে মাফ করতে পারেন বা তাওবার দ্বারা মাফ করা হয়। যদিও আত্মহত্যাকারীর জন্য তাওবার সুযোগ নেই। তাওবা করতে না পারলেও আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে ঈমানদার হওয়ার কারণে দীর্ঘ শাস্তি ভোগের পর নিজ রহমতে আত্মহত্যাকারীকেও মাফ করে দিতে পারেন। কেউ যদি আত্মহত্যাকে হালাল মনে করে আত্মহত্যা করে তবে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী । আল্লাহ আমাদের রহম করুক , আমিন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আত্মহত্যা প্রতিকারে ইসলাম
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ