ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল
আব্বাস উদ্দীন আহমদ বাংলার লোকসঙ্গীতের এক প্রবাদ পুরুষ। তাঁর জন্ম কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বলরামপুর গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর। বাবার নাম মোহাম্মদ জাফর আলী। তিনি কোচবিহার জেলার একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ও জোতদার ছিলেন। মা হিরামন নেসা।
আব্বাস উদ্দীন আহমদ শৈশবকাল থেকেই তীক্ষè বুদ্ধি ও মেধাসম্পন্ন ছিলেন। লেখাপাড়ায় তিনি খুবই ভাল ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন শিক্ষকদের খুব আদরের। মাটির পৃথিবীর চিরন্তন ঐকতান তার কণ্ঠে বাসা বেঁধেছে শৈশবকাল থেকেই। তিনি একজন ভাল শিল্পী ছিলেন শিশুকাল থেকেই। কিন্তু সেই কালে তিনি কোন ওস্তাদের কাছে গান শেখার সুযোগ পাননি। তিনি গান শিখেছেন গ্রাম্য গায়ক এবং ক্ষেতে কর্মরত কৃষকের মুখের গান শুনে শুনে। বাড়ির সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কৃষকের উদাত্ত কণ্ঠের ভাওয়াইয়া গান তার শিশুমনে আলোড়ন তুলতো। তাকে ভাওয়াইয়া শিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল তারই গ্রামের শিল্পী পাগারু এবং নায়েব আলী টেপুর ভাওয়াইয়া গান ও দোতারার ডাং। স্কুলে যাবার সময় এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি গলা ছেড়ে গাইতেন ভাওয়াইয়া।
কোচবিহারের বলরামপুর প্রাইমারি স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তুফানগঞ্জে অধ্যয়নকালে স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। আব্বাস উদ্দীন আহমদ ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন তুফানগঞ্জ হাই স্কুল থেকে। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে। কৃতিত্বের সাথে আইএ পাস করার পর তিনি বিএ পড়তে আসেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে এবং পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি দিন লেখাপাড়ার সুযোগ পাননি। এরপর তিনি বিএ ভর্তি হন কোচবিহার কলেজে।
কলকাতা মহানগরীতে বিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শুরু করেন সংগ্রামী শিল্পী জীবন। বাংলাদেশের মুসলমানের হৃদয়ে পৌঁছানোর ছিল সে সময় ছিল দুটি পথ। তার একটি তাদের মনের কথা এ দেশের লোকগীতি অপরটি তাদের প্রাণের কথা ইসলামী গান। আব্বাস উদ্দীন বেছে নিয়েছিলেন এই দুটি পথ। বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল ও আব্বাস উদ্দীন এ দুটি নাম যেদিন যুক্ত হলো সেদিন থেকে সঙ্গীতে অনুপস্থিত বাঙালি মুসলমানের দীনতা ঘুচলো।
হিন্দু সমাজে যখন মুসলমান শিল্পীরা ছিলেন অস্পৃশ্য তখন বাংলার সঙ্গীত জগতে এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হলো। এ নবদিগন্তের স্রষ্টা হলেন আব্বাস উদ্দীন আহমদ। নজরুল এলেন সঙ্গীতের জগতে ধূমকেতুর মতো কালবৈশাখীর ঝড় তুলে, আব্বাস উদ্দীন এলেন সুরের মশাল নিয়ে। কোচবিহারের এক অনুষ্ঠানে আব্বাস উদ্দীনের গান শুনে কাজী নজরুল ইসলাম বিমোহিত হয়েছিলেন। তাকে তিনি কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
আব্বাস উদ্দীন আহমদ মাত্র ২৩ বছর বয়সে কলকাতায় গ্রামোফন কোম্পানীতে দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন বিমল দাশগুপ্তের সহায়তায়। গান দুটি ছিল ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো’ এবং ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’। গান দুটি সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর আব্বাস উদ্দীন আহমদ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ সময় কাজী নজরুল ইসলামের গভীর সান্নিধ্যে আসেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতায় আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামী গানের পাশাপাশি একাধিক ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ড হয়েছিল। এই গানগুলি সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরবর্তীতে রেকর্ডে আব্বাস উদ্দীনের কী গান বাজারে আসছে সেই গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করতো গ্রামোফন কোম্পানীর লাখো লাখো শ্রোতা।
নজরুল গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। আব্বাস উদ্দীনের বলিষ্ঠ দরদী কণ্ঠে সে গান রেকর্ড, জনসভা ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। ভাওয়াইয়া গানে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর আবহমানকাল হতে হয়েছে সমৃদ্ধ। আব্বাস উদ্দীন ভাওয়াইয়া গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে তুলে এনে শহরের শিক্ষিত মানুষের ড্রইং রুমে জায়গা করে দিয়েছেন। ভাওয়াইয়া গানকে যারা গ্রামের অভব্য শ্রেণীর গান বলে ঘৃণা করতেন তারাও গোপনে তাদের ড্রইং রুমে বসে বিমুগ্ধ হয়ে শুনতেন আব্বাস উদ্দীন আহমদের মধুঝরা গান।
আব্বাস উদ্দীন আহমদের গ্রামোফন কোম্পানীতে গাওয়া বহু গানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮৪টি ইসলামী গান, পল্লীগীতি ৫৮টি, ভাওয়াইয়া ৩৭টি, কাব্যগীতি ৩১টি এবং তাঁর আধুনিক গানের সংখ্যাও অনেক। ইসলামী গানকে তিনি কন্ঠে ধারণ করেছিলেন বলেই তৎকালীন মুসলিম রেঁনেসার সূত্রপাত হয়েছিল। যে মুসলমানরা গানকে পছন্দ করতেন না তারাই পরবর্তীতে আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে অবাক বিস্ময়ে শুনতেন ‘মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘ত্রি ভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়’ প্রভৃতি বিখ্যাত ইসলামী গান। পরবর্তীতে নজরুলের লেখা ও সুর করা রোজা, নামাজ, হজ, যাকাত, শবেবরাত, ঈদ, ফাতেহা, নাতে রসূল, ইসলামী গজল প্রভৃতিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্বাস উদ্দীন।
বাংলার মুসলিম সমাজে যেখান থেকে আসতো আহ্বান, তা উপেক্ষা না করে আব্বাস উদ্দীন শত কষ্ট জেনেও ছুটে যেতেন তাদের আহ্বানে। ছাত্রদের মিলাদের সভা, স্কুল-কলেজের চ্যারিটি শো, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠানে। ভাওয়াইয়া ও ইসলামী গানের পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন অসংখ্য পল্লীগীতি, মুর্শিদী, মর্শিয়া, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, হামদ, নাত, পালাগান ইত্যাদি। শুধু গান গেয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। গায়কের পাশাপাশি একজন শক্তিশালী অভিনেতাও ছিলেন। তিনি সেকালের বিষ্ণুপ্রিয়, মহানিশা, একটি কথা এবং ঠিকাদার ছবিতে ও অভিনয় করেছিলেন।
শুধু দেশ নয়, শিকাগো, নিউইয়র্ক, লল্ডন, প্যারিস, টোকিও, মেলবোর্নসহ পৃথিবীর শহরে ইসলামী গান, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি পরিবেশন করে বিশ্বসভায় আমাদের বাংলা গানকে তিনি সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় দক্ষিণ এশিয়া সঙ্গীত সম্মেলনে এবং ১৯৫৬ সালে জার্মানী আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনসহ আরও নানা সম্মেলন ও উৎসবে অংশ নিয়ে তিনি এ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলেন।
পল্লীগীতি, ইসলামী গান ও ভাওয়াইয়া গানের অমর শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগ ভোগের পর ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৭-৩০ মিনিটে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর (১৯০১-১৯৫৯ খ্রি:) তাঁকে ঢাকার আজিমপুর কবর স্থানে সমাহিত করা হয়।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।