Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যমুনার ভাঙ্গনে মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে ছয়টি উপজেলা

ভাঙ্গন কবলিত মানুষ হচ্ছে রিক্ত,নি:স্ব,সর্বস্বান্ত

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:৩৩ পিএম

প্রমত্তা যমুনা নদীর হিংস্রা থাবায় সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার দু’পাড়ের ৬টি উপজেলা মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ হয়ে পড়েছে রিক্ত নি:স্ব সর্বস্বান্ত। কেউ হারিয়েছে ভিটামাটি, বসতভিটা, কেউ করছে ভিক্ষাবৃত্তি, আবার কেউ হারিয়েছে ভোটের নায্য অধিকার।

নদী মাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের নদ নদী অনবরত তাদের স্রোতধারা পরিবর্তন করে সময়ে সময়ে গড়ে তুলেছে নানা সভ্যতা। ঠিক তেমনি আবার সময়ে সময়ে ধ্বংসের তান্ডবে লাখো মানুষকে করছে সর্বশান্ত। নদ নদী বিধৌত এ দেশে ভাঙ্গন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। কোনো কোনো নদী বছরের ১২ মাস ধরেই নানা গতিতে মাতে ভাঙ্গন খেলায়। আর রেখে যায় দীর্ঘ মেয়াদী ভাঙ্গনের ক্ষতের ছাপ। এতে প্রতি বছর গৃহহীন উদ্বাস্ত লোকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে। তেমনি সরকারের কোটি কোটি টাকাও বিলীন হচ্ছে নদীর গর্ভে। সামগ্রিকভাবে এর ভয়াবহতা প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও।

এরই ধারাবাহিকতায় সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর ভাঙ্গনে পাল্টে যাচ্ছে ৬টি উপজেলার দৃশ্যপট। কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল ফসলের মাঠ, হাট বাজার, বসতভিটা ও খেলার মাঠ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন সেখানে নদী বইছে নিরবধি। যমুনা পাড়ের অসহায় মানুষের চোখের জলে এখন একাকার নদীর ধারা। ভাঙ্গর রোধে জরুরীভাবে ফেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জিও ব্যাগ ও রাক্ষসী যমুনার করাল থাবা থামাতে ব্যার্থ হচ্ছে। ফলে যমুনার উভয় কুলের ৬টি উপজেলা জেলার মানচিত্র থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট।

জানাগেছে, করালগ্রাসী রাক্ষসী যমুনা গিলে খাচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। যমুনা নদী ভাঙ্গন রক্ষায় রিং বাঁধ, নদী তীর সংরক্ষন বাঁধ, এমনি মেঘা প্রকল্প ১শত বছরের গ্যারান্টিযুক্ত গ্রোয়েনেরও শক্ত কাঠামো ধ্বংস নামছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে। সম্প্রতিকালের বন্যায় সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ভাঙ্গন দেখা গেছে। জেলা শহর রক্ষা বাঁধ কয়েক দফায় ভেঙ্গেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার নদী তীর রক্ষা বাঁধ এ যাবৎ ১৫/১৬ দফায় ভেঙ্গে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে। ভাংতে ভাংতে চৌহালী উপজেলা এখন টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে মিছে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ৫শত কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মীত এনায়েতপুর খাজা মেডিক্যাল হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়। একইভাবে দক্ষিনের পাবনা ভেড়াকোলা থেকে উত্তরের কাউনিয়া পর্যন্ত ১৩৫ মইল দীর্ঘ ব্রম্যপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। কোথাও কোথাও মুলবাঁধ ভেঙ্গে রিংবাঁধ ভেড়ী বাঁধ নির্মান করেও সুফল মেলেনি।

প্রায় একযুগ ধরে কাজিপুর উপজেলার নাটোয়ারপাড়াচরসহ দূর্গম চরাঞ্চল ভাঙ্গছে। ভাঙ্গছে নদী, ভাঙ্গছে জনপদ, ভাংছে হাজারো মনুষের কপাল। সর্বস্তহারা হচ্ছে ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ। ফলে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে জেলার কাজীপুর উপজেলা মিলিত হচ্ছে জামালপুর জেলার সঙ্গে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর ও চৌহালী উপজেলাটি তাই মানচিত্র মুছে যাচ্ছে। এছাড়া নদী তীরবর্তী সদর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালি, কাজীপুরের ৫টি উপজেলাও ভাঙ্গনের মুখে। একইভাবে গত বন্যায় টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতি, নাগপুর ও ভ‚য়াপুর ৪টি উপজেলায় পাল্টে যাচ্ছে মানচিত্র। যমুনা ভয়াবহ ভাঙ্গনের তীব্রতা এতটাই বেড়ে গেছে মুহুর্তের মধ্যে হারিয়ে যায় বাড়িঘর, বসতভিটা, ফ্যাক্টরী, ‘স’মিল ও পৌনীচরের হাট, ইতিমধ্যেই নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একইভাবে হুগড়া ইউনিয়নের মাসপুর, বারবেলা, চকগোপাল, কচুয়া, কাতুলী,ইছাপাশা, খোশলিয়া, চানপাড়া, মাহমদনগড়,ইউনিয়নের মাকড়কোলা, কেশর মাইঝাইল, তিতলিয়া, নয়াপাড়া, কুকরিয়া, কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ি ইউনিয়নের আলীপুর, ভৈরববাড়ী, নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের পাইকশা, মাইঝাইল, খাসখুনিপাড়া, খাস তেবাড়িয়া,চরসলিমাবাদ ভ‚তের মোড়, ভারড়া ইউনিয়নের শাহজানি, ভারড়া, পাঁচতারা, আগদীঘুলিয়া। ভ‚য়াপুর ইউনিয়নের ভালকাটিয়া এলাকা গ্রাস করছে রাক্ষসী যমুনা। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের উত্তর চরকোলী, দশাখাদা, হাট খোলা, দশখাদা, হাটখোলা,চরপনিহারখোলা সম্পন্ন নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। টাঙ্গাইল সদর ও কালিহাতি উপজেলার সীমান্ত এলাকা উত্তরচরপৌলী ও আলীপুর গ্রামের অংশে অসমাপ্ত শেখ হাসিনা সড়ক (নর্দান প্রজেক্ট) রক্ষায় সড়কটি ৫/৬শত মিটার চলে গেছে নদী গর্ভে। যমুনার তীব্র ¯্রােতের মুখে জিওব্যাগ ফেলেও ভাঙ্গন রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এভাবেই পাল্টে গেছে টাঙ্গাইলের চার উপজেলার মানচিত্র।

কাকুয়া ইউনিয়নের ক্বারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার দাদার ১৫০ বিঘা জমি ছিল। রাক্ষসী যমুনা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তার সীমানা বড় করেছে। আর আমাদের করেছে নি:স্ব। চরপৌলীর কবরস্থান পাড়ার আব্দুল গফুর মন্ডল জানান, গত ৭জুলাই বিকেলে হঠাৎ যমুনা বিক্ষুব্ধ হয়ে আধা ঘন্টার মধ্যেই ৬০ শতাংশের বাড়ি ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যায়। পাশের হাটে বাজার করতে গিয়েছিলেন তারা। চিৎকার চেচামেচি শুনে দৌড়ে এসে দেখেন তাদের বাড়ি ঘর আর নেই। মুহুর্তের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে সর্বগ্রাসী যমুনা। এভাবে চোখের পলকে সবকিছু ক্রমে ক্রমে নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। তাদের দাবি বঙ্গবন্ধু সেতৃ হয়ে মাহমুদনগর ইউনিয়নের গোল চত্ত¡র পর্যন্ত স্থায়ী বাঁধ নির্মান করা জরুরী প্রয়োজন।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এ জেলার চরাঞ্চলের বিশাল এলাকা প্রতিবছরই যমুনার ভাঙ্গনের শিকার। এ ভাঙ্গনরোধে তিন বছর পূর্বে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মানের প্রকল্প মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ তিন বছরে সেটা আলোর মুখ দেখেনি। তাই জরুরী ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবেই সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলা ৬টি উপজেলার চিত্র মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী ভাঙ্গন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ