Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ষণ কমবে যদি শাস্তি নিশ্চিত হয়

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

গত ২২ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০২০-২১ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও রাহাজানির ঘটনা বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধর্ষণ মামলা ৫ হাজার ৮৪২টি, ২০২০-২১ অর্থবছর বেড়ে ৭ হাজার ২২২টি। নারী নির্যাতন ১২ হাজার ৬৬০টি থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৭টি।
মৃত্যুদন্ডের মতো কঠোর সাজা নির্ধারিত হলে ধর্ষণ নিরুদ্ধ হবে এমনটাই আমরা মনে করছিলাম। মৃত্যুদন্ডের আইনের পর ধর্ষণ বেড়েছে, এমন খবর আমাদের আশাহত করে বৈকি! তাহলে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণ কী বাংলাদেশে বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষ বেড়ে যাওয়া? চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় অবাক হওয়ার মতোই একটি ঘটনা ঘটেছিলো ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। এক বছর আট মাসের এক শিশু, যে কিনা মায়ের দুধ গ্রহণ করতো সেই শিশুটি শিকার হয়েছে ধর্ষণের। আমরা অবাক হয়েছি, বাড্ডায় তিন বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায়। আর উত্তরায় চার বছরের শিশু ধর্ষণে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় আমরা বিস্মিত হই।
অনেকে মনে করেন, বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে এবং সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, তা থেকে বের হতে হবে। কেবল আইন প্রণয়ন নয়, ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আওতায় আনতে হবে। এদেশে ধর্ষিতারা বিচার পায় না, সমাজচ্যুত হয়। তাই বিচারহীনতায় দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছেই। এদেশে এমন ঘটনা নতুন নয়, অহড়হই ঘটছে। কত সংবাদপত্রে জায়গা পায় আবার বাকি সব ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। অধিকাংশ ঘটনায়ই সমাজের বিচারপতিরা অপরাধীর পক্ষ নেয়, উল্টো ভিক্টিম কিংবা তাঁর পরিবারকে ফাঁসিয়ে দেয়।
যৌনতা মানুষের জীবনের একটি অন্যতম অধিকার, সেটা সবাই জানি। তবে এই যৌনতাকে বিকৃত করে উপস্থাপন কাম্য নয়। আর সেটাই হচ্ছে ধর্ষণ। সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেওয়া এই ধর্ষণ উঠে এসেছে পাশ্চাত্য দেশগুলোর অসভ্য এক নোংরা সংস্কৃতি থেকে। যা বাংলাদেশ একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তর হয়েছে। নেশাদ্রব্যের মতো স্মার্টফোনের মধ্যে রক্ষিত যৌন সুড়সুড়ি দেয়া বিনোদনসামগ্রী প্রতি মুহূর্তেই ইন্দ্রীয় লালসায় উন্মত্ত করে তুলছে। স্মার্টফোন যত সহজে একজনকে উত্তেজিত করতে পারে, এমনটি এর আগে কোনো যন্ত্র করতে পারেনি। স্মার্টফোন যে যৌন উদ্দীপনা, মাদকতা আনতে পারে অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব না। তার পরিণতি খুবই ভয়ানক।
ধর্ষণ! ধর্ষণের পর খুন! দিনের পর দিন আমাদের দেশে এ জাতীয় অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলছে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়, বলা যায় আমাদের সমাজ বাস্তবতার এক করুণ চিত্র। খুন, ধর্ষণ আজকাল এই আধুনিক পৃথিবীর নিত্য নৈমেত্তিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এর মাত্রা যেন সব বিচিত্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষরূপী নরপশু সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে হায়েনার নখ মেলে বসেছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ। অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কিৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতি করছে তা হাল আমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। রাত-বিরাতে নয় শুধু, দিন দুপুরে প্রকাশ্য ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। শুধু ধর্ষণই নয়, গণধর্ষণও হচ্ছে। দ্রুততম সময়ে অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়বে, এটি চির অবধারিত। এ ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার প্রধান কারণ। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে।
১৯৯৫ সালের বহুল আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণ হত্যার মধ্য দিয়ে একটি অসহনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এরপর মধুপুরে কিশোরী ধর্ষণ ঘটনা বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চন্দন কুমার পোদ্দার তার বাসার কাজের মেয়ে শুক্ল দে (১৫) কে অনেকদিন থেকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে আসছিল। লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা কাউকে বলেনি কাজের মেয়ে শুক্লা। কিন্তু দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শুক্লা ধর্ষকের স্ত্রীকে তার স্বামীর ধর্ষণের ঘটনা জানিয়ে দেয়। এরপর ধর্ষকের স্ত্রী ও কাজের মেয়ে ঐ দিন থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ধর্ষক চন্দন কুমার পোদ্দারকে চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকার হাইলেভেল রোডের বাসা থেকে আটক করে। গাজীপুর-৪ কাপাসিয়া আসনের সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির কথিত এপিএস কাজল মোল্লা কিশোরী গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও তার স্ত্রীর অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনায় উপজেলাজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছিল। গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ২০২০ সালে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদ-ে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদ- হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন আছে ঠিকই কিন্তু আইনকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাঁটেন না। মামলার চার্জশিট গঠনের সময় ফাঁক-ফোঁকড় থেকে যায়। তাই শেষে রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার লোকজন সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
যৌন নির্যাতন তথা ব্যভিচার সর্বযুগে সর্বধর্ম মতে নিকৃষ্টতম পাপাচার। আল-কুরআনের বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ ব্যভিচার সম্পর্কিত পাপের ভয়াবহতা ও এর কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে মানব জাতিকে সাবধান হতে বলেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না, কারণ এটা একটা অশ্লীল এবং জঘন্য পন্থা। এ অপরাধ কোন দেশে কোন যুগেই বন্ধ ছিল না। এখনো নেই। কোনো অপরাধ কখনই নিঃশেষ করা যায় না কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যে কোনোমূল্যে নিয়ন্ত্র করতে হবে। আমরা নারীকে বানিয়েছি ভোগের বস্তু। এ মানসিকতা দূর করতে হবে। নারীকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। পরনারীকে কখনো মা, কখনো বোন, কখনো বা মেয়ে ভাবতে হবে। তাদের উপর লুলুপ দৃষ্টি নয় মায়ামমতার দৃষ্টি দিতে হবে।
নারী দেখলেই কেন ধর্ষণ করতে হবে? সব দোষ নারীর? সব দোষ পাশাকের? এমন মানসিকতা কেন আমাদের। ধর্মে নারীকে পর্দা করতে বলার পাশাপাশি পুরুষদেরর চোখ অবনত রাখতে বলা বয়েছে। তবে শুধু নারীর দোষ কেন? নারীর রূপ যৌবন পুরুষকে মোহিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তার উপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মাঝে মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণরোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন সুড়সুড়িমূলক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লির নাটক-সিনেমা ইত্যাদি কামোত্তেজনা মানুষকে প্রবলভাবে ব্যাভিচারে প্ররোচিত করে তা বর্জন করতে হবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সময়মত বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা ও যৌন শিক্ষার গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালীন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোশাক বর্জন করতে হবে। প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে ফেলে। ব্যাপকভাবে কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণগুলোর কাছাকাছি চলে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আর কোনো উপায়ই থাকে না।
ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগে কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে স্কুল-কলেজ, মাদরাাসা-মক্তব-মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ নিশ্চত করতে হবে। তবেই ধর্ষণ কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • jack ali ৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:২৮ পিএম says : 0
    Only Allah's rule can solve this heinous crime.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ


আরও
আরও পড়ুন